৩১ বছরেও শেষ হয়নি সাক্ষ্য, বাদী মারা গেছেন ২১ বছর

ডিএমপির ২ লাখ ১২ হাজার ৫৮৮ মামলা বিচারাধীন

প্রকাশিত: ১২:১২ অপরাহ্ণ, মে ১২, ২০২৫

নিজেস্ব প্রতিবেদক:

 

রাজধানীর হাবীবুল্লাহ বাহার কলেজে পড়তেন নাসরিন জাহান। বাসা ছিল মালিবাগে। সম্পর্কে জড়ান এক বেকার যুবকের সঙ্গে। নাম চৌধুরী জালাল উদ্দিন মো. গোলাম দস্তগীর কচি। গভীর সেই সম্পর্ক গড়ায় বিয়েতে। ১৯৮২ সালে বেকার কচিকে বিয়ে করেন নাসরিন। কারও পরিবারই বিয়ে মেনে নেয়নি। নতুন সংসার; কিন্তু কারও উপার্জন নেই। অনেক চেষ্টা করে টেলিফোন এক্সচেঞ্জে অপারেটরের চাকরি নেন নাসরিন। তা দিয়েই চলছিল ভালোই। পরে সন্তানও হয় তাদের। দুই পরিবারের মিলনও হয়। শ্বশুরের সহায়তায় নাখালপাড়ায় কিন্ডারগার্টেন স্কুল দেন কচি। স্কুলের প্রধান শিক্ষিকার সঙ্গে কচির সম্পর্কের জেরে শুরু হয় কলহ। ১৯৯৪ সালের অক্টোবরের এক রাতে স্বামীর হাতে বিষ মেশানো ভাত খেয়ে মারা যান নাসরিন।

কচি ও তাঁর পরিবার স্ট্রোকে নাসরিনের মৃত্যু বলে প্রচার করে। সন্দেহ হওয়ায় বাবা মুজিবুর রহমান মতিঝিল (তখন মালিবাগ মতিঝিলের আওতাধীন) থানায় অপমৃত্যু মামলা করে ময়নাতদন্তের আরজি জানান। ময়নাতদন্তে বেরিয়ে আসে, কীটনাশক পানে মারা গেছেন নাসরিন। এর পর সিআইডির তৎকালীন পরিদর্শক আবদুল মতিন মতিঝিল থানায় হত্যা মামলা করেন।

প্রায় ৩১ বছর পেরিয়ে গেছে; কিন্তু সেই মামলার সাক্ষ্য গ্রহণ এখনও শেষ হয়নি। বিচারের আশায় থেকে থেকে নাসরিনের বাবা মুজিবুর রহমান মারা গেছেন; তাও ২১ বছর আগে। আসামি-সাক্ষী অনেকের বাসার হোল্ডিং নম্বর, থানা– সবই পাল্টে গেছে। বেঁচে থাকা স্বজনরা এখনও আছেন ন্যায়বিচারের অপেক্ষায়।

ঢাকার আদালতগুলোতে বিচারাধীন মামলার তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে এ তথ্য বেরিয়ে এসেছে। গত ২৮ এপ্রিল পুরান ঢাকার আদালতপাড়ায় গিয়ে ১২ মে তৃতীয় বিশেষ আদালতে একটি হত্যা মামলার শুনানির দিন পাওয়া যায়। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৩ সালে মামলাটিতে সর্বশেষ দু’জন সাক্ষ্য দেন। এর পর বহুবার পড়েছে শুনানির দিন, হাজির হননি কেউ। মামলাটির সূত্র ধরে খোঁজ নিতে গিয়ে বেরিয়ে আসে নানা সংকটের চিত্র।

পুলিশের তথ্যমতে, গত মার্চ পর্যন্ত পাওয়া হিসাবে ঢাকা মহানগর পুলিশের ৫০ থানার এমন ২ লাখ ১২ হাজার ৫৮৮ মামলা বিভিন্ন আদালতে বিচারাধীন। এর মধ্যে খুনের মামলা ২ হাজার ৭২৩টি। সবচেয়ে বেশি মামলা ঝুলে রয়েছে মাদকদ্রব্য উদ্ধার-সংক্রান্ত, ১ লাখ ৩৪ হাজার ১১১টি। এ ছাড়া ধর্ষণের মামলা ৩ হাজার ৯১৩, অপহরণের ৮৩৯, নারী ও শিশু নির্যাতনের ৫ হাজার ৯১৪, ডাকাতি ও দস্যুতার ১ হাজার ৯২৩টি।

নাসরিন হত্যা মামলার খোঁজে নেমে এমন বহু বছর ধরে ঝুলে থাকা আরও অনেক মামলার খোঁজ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৯টি মামলা বিশ্লেষণ করেছে সমকাল।

নাসরিন হত্যা
১৯৯৪ সালের ২৮ অক্টোবর খুন হন নাসরিন জাহান। পরে মামলার তদন্ত শেষে সিআইডির তৎকালীন পরিদর্শক নজরুল ইসলাম ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেন। এতে কচি ও তাঁর দুই ভাই চৌধুরী সালাউদ্দিন আহাম্মদ কবির ওরফে বাবু ও চৌধুরী সাহাবউদ্দিন মো. জাহাঙ্গীরকে আসামি করা হয়। সাক্ষী করা হয় ৩৪ জনকে। নথিপত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, ৩১ বছরে মাত্র ১২ জন সাক্ষ্য দিয়েছেন। এমনকি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নজরুল ইসলামও সাক্ষ্য দেননি। একাধিকবার সমনেও তিনি আদালতে হাজির হননি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অনেক সাক্ষী সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য কোনো সমন, আদেশ বা খবর পাননি। মামলার চার নম্বর সাক্ষী কবির আহাম্মদ সমকালকে বলেন, ‘আমি আজ পর্যন্ত সাক্ষ্য প্রদানের বিষয়ে কোনো সমন পাইনি। কারও মাধ্যমেই কোনো সংবাদ দেওয়া হয়নি আমাকে। আমার বড় ভাবি ছালেহা বেগমের কাছেও সাক্ষ্য দেওয়ার বিষয়ে কোনো কাগজ আসেনি। ফলে এতদিন সাক্ষী দিতে পারিনি আমরা।’

ঠিকানা বদল
মালিবাগের ৪২৫ নম্বর বাড়িতে স্ত্রী ও দুই ছেলেকে নিয়ে থাকতেন কচি। এজাহারেও এ ঠিকানা রয়েছে। গত বুধবার (৩০ এপ্রিল) সরেজমিন ঘুরে ৪২৫ নম্বরে কোনো বাড়ি পাওয়া যায়নি। ৪২৩ ও ৪২৪ নম্বর বাড়ির খোঁজ মিলেছে, তবে সেখানে অন্য মানুষের বসবাস। স্থানীয়রা জানান, কচি বহু আগে তাদের বাড়ি বিক্রি করে অন্যত্র চলে গেছেন। অন্য দুই আসামিকেও খুঁজে পাওয়া যায়নি।

এজাহারে নাসরিনের বাবার বাড়ির ঠিকানা শহীদবাগের একটি হোল্ডিং। খোঁজাখুঁজির পর বাড়িটি পাওয়া যায়। আশপাশের বাসিন্দারা জানান, নাসরিনের বাবা মুজিবুর রহমান অনেক আগে মারা গেছেন। জমির একাংশ বিক্রি হয়ে গেছে। নাসরিনের ভাই কবির আহাম্মদও ওই এলাকায় থাকেন না। অন্যত্র চলে গেছেন।

ওই বাড়িতে কবিরের প্রয়াত ভাইয়ের স্ত্রী ছালেহা বেগম থাকেন। তিনিও নাসরিন হত্যা মামলার সাক্ষী। কলিংবেল চাপলে তিনতলা থেকে বেরিয়ে আসেন এক তরুণী। ছালেহার কথা জিজ্ঞেস করলে তিনি জবাব দেন, ‘বাসায় নেই’। তার কাছ থেকে মোবাইল ফোন নম্বর নিয়ে কথা হয় ছালেহার সঙ্গে। তিনি নাসরিনের ভাই কবির আহাম্মদের ফোন নম্বর দেন।

যোগাযোগ করলে কবির জানান, তারা তিন বোন ও চার ভাই। বাবা ছাড়াও নাসরিনসহ দুই বোন এবং দুই ভাই মারা গেছেন। তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমরা ভুলতেই বসেছি। বাবাসহ আমরা দীর্ঘদিন আদালতে ঘুরেছি। বিচার না পেয়ে উৎসাহ হারিয়ে ফেলি। তবে আগামীতে সাক্ষী শুনানি থাকলে আদালতে যাব।’

আক্ষেপ করে কবির বলেন, ‘আমার বোনের কপালই মন্দ! সবকিছু তুচ্ছ করে কচিকে বেছে নিল। অথচ পরনারীতে মজে কচি নাসরিনকেই শেষ করে দিল। পাঁচ বছর মুখ বুজে স্বামীর নির্যাতন সহ্য করেও বাঁচতে পারেনি। আমি তার সর্বোচ্চ শাস্তি চাই।’

কচির ব্যাপারে জানতে চাইলে কবির বলেন, ‘কচি মালিবাগের বাড়ি বিক্রি করে গুলশানে বসবাস করছিলেন। সেখানেও থাকেন না শুনেছি। বছর চারেক আগে মালিবাগে দেখা হয়েছিল। খুনিকে দেখে ক্ষোভ ধরে রাখতে পারিনি। গালাগাল করে চলে আসি।’

কবির জানান, অপমৃত্যু মামলায় পুলিশ কচিকে গ্রেপ্তার করে। কয়েক দিন বাদেই জামিনে বেরিয়ে মামলা তুলে নিতে হুমকিধমকি দেন।

নাসরিনের এক ছেলে কানাডা; অন্যজন আমেরিকায় থাকেন। তবে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ নেই বলে জানান কবির।

মামলার বাদী সিআইডির তৎকালীন পরিদর্শক আবদুল মতিনের বিষয়ে কোনো তথ্য পুলিশ দিতে পারেনি। এমনকি তদন্ত কর্মকর্তা নজরুল ইসলামের বিষয়েও কোনো তথ্য নেই বলে জানান কর্মকর্তারা।

আরও মামলার চিত্র
দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা ৯টি মামলা বিশ্লেষণ করেছে সমকাল। এর মধ্যে দুটি মামলায় একজনও সাক্ষ্য দেননি। অন্য সাত মামলার সাক্ষ্য শেষ হয়নি।

২০০৪ সালের ২৬ জুলাই কারওয়ান বাজারে চাঁদাবাজির সময় বোমা, দেশীয় অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হয় বিল্লাল হোসেন, মারুফ হোসেন ও মুনছুর আলী। তেজগাঁও থানার মামলায় ওই বছরের ২৫ আগস্ট তৎকালীন এসআই খবীর আহম্মেদ আদালতে চার্জশিট দেন। ২২ বছরে সাত সাক্ষীর একজনও সাক্ষ্য দেননি।

১০৮ বোতল ফেনসিডলসহ পুরান ঢাকার সূত্রাপুরে গ্রেপ্তার হন ওমর হোসেন কুট্টি। ২০০৫ সালের ১৭ এপ্রিলের ঘটনায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সূত্রাপুর সার্কেলের তৎকালীন পরিদর্শক আবুল কালাম আজাদ মামলা করেন। একই বছরের ২৮ এপ্রিল আদালতে চার্জশিট দেওয়া হয়। ছয় সাক্ষীর মধ্যে চারজন সাক্ষ্য দিয়েছেন। তবে তদন্ত কর্মকর্তা আলমগীর পাশাসহ তিনজন সাক্ষ্য না দেওয়ায় ২০ বছর ধরে মামলাটি নিষ্পত্তি হয়নি। চলতি বছরের জানুয়ারিতে মারা গেছেন পদোন্নতি পেয়ে সর্বশেষ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের বগুড়া জেলা কার্যালয়ের পরিদর্শক হিসেবে কর্মরত আলমগীর পাশা।

২০০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি রাতে শুক্রাবাদে অভিযান চালিয়ে ডিবি দুই বোতল ফেনসিডলসহ রতন মোহাম্মদকে গ্রেপ্তার করে। মোহাম্মদপুর থানার মামলায় ওই বছরের ১৬ মার্চ আদালতে অভিযোগপত্র দেন ডিবির তৎকালীন এসআই নাসির উদ্দীন। ১৬ বছরে একজনও সাক্ষ্য দেননি। ঢাকার চতুর্থ দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে আগামী ২৭ মে সাক্ষ্য গ্রহণের দিন ধার্য রয়েছে।

২০১১ সালের ৩ আগস্ট আসাদগেট এলাকায় একটি বেসরকারি ব্যাংক থেকে ৮ লাখ টাকা উত্তোলন করে নিয়ে যাওয়ার সময় প্রাইম অ্যাসোসিয়েটসের প্রকৌশলী রবিউল ইসলামকে গুলি করে ওই টাকা ছিনতাই করে দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় ২০১৫ সালের এপ্রিলে চার্জশিট দেওয়া হয়। এতে সাক্ষী করা হয় ২০ জনকে। এ পর্যন্ত আটজন সাক্ষ্য দিয়েছেন। মামলাটি ঢাকা চতুর্থ দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন।

যা বললেন বিশেষজ্ঞরা
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের পিপি ওমর ফারুক ফারুকী বলেন, গত সাড়ে ১৫ বছর ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকার রাজনৈতিক মামলা নিয়ে আদালতগুলোকে চাপে রেখেছিল। অন্যান্য মামলা গুরুত্ব পায়নি। সাক্ষী থাকলেও এখন পুলিশ সদস্যদের অনেকেই নেই। কেউ চাকরি ছেড়েছেন; কেউ পলাতক। এর পরও নন-ভ্যালুয়েবল ওয়ারেন্ট দিয়ে সাক্ষীদের হাজির করার চেষ্টা চলছে। আগামী ছয় মাসের মধ্যে অনেক মামলা নিষ্পত্তি হবে।

মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক সমকালকে বলেন, ‘বিচারের দীর্ঘসূত্রতা মামলাজট তৈরি করে। সবাই ভোগান্তির শিকার হন। এ অব্যবস্থাপনার জন্য রাষ্ট্র দায়ী। আবার ভুক্তভোগী কিংবা তাদের স্বজন জীবদ্দশায় বিচার দেখে যেতে পারেন না। এতে বিচার ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা তৈরি হয়। বিচার প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হলে সমাজে অপরাধের মাত্রা কমবে।’

তিনি বলেন, ‘সাক্ষ্য দেওয়াকে ঝুঁকিপূর্ণ ভেবে অনেকেই অনীহা দেখান। আবার সাক্ষীর সুরক্ষা আইন, প্রণোদনাসহ রাষ্ট্রীয়ভাবে তেমন কিছুই নেই। সাক্ষীর অভাবে মামলাগুলো আলোর মুখ দেখছে না।’

ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ আমিনুল গণি টিটো বলেন, ‘দীর্ঘসূত্রতার অন্যতম কারণ সাক্ষী না পাওয়া। বিশেষ করে মহানগরে সাক্ষীদের অনেকেই ভাড়া থাকেন। প্রয়োজনে অন্যত্র স্থানান্তরিত হলে তাদের আদালতে উপস্থাপন করা কঠিন হয়ে পড়ে।’