
সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি:
সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জে ‘আরাফাত-শরীফের ব্যক্তিগত বন্দিশালায় দুই নারী-পুরুষ জিম্মি ও উদ্ধারের’ ঘটনার তিন দিন পর রায়গঞ্জ ও এনায়েতপুর থানার ওসি প্রত্যাহারসহ জেলার ৫ থানার ওসি রদবদল করা হয়েছে।
গতকাল সোমবার পুলিশ সুপারের কার্যালয় থেকে জারিকৃত আদেশপত্রে ওসি প্রত্যাহার-রদবদলের বিষয়টি জানানো হয়। পত্রে ‘জনস্বার্থ’ লেখা থাকলেও অনেকের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়মে জড়িয়ে পড়াসহ ‘দায়িত্ব অবহেলার’ অভিযোগ রয়েছে।
প্রত্যাহারকৃত ওসিরা হলেন, রায়গঞ্জের মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান ও এনায়েতপুরের মোহা. রওশন ইয়াজদানী। এদেরকে শাস্তিমূলক পুলিশ লাইন্সে সংযুক্ত করা হয়েছে।
রদবদলকৃত তিন ওসি হলেন, সদরের হুমায়ন কবির, সলঙ্গার মোখলেসুর রহমান ও যমুনা সেতু পশ্চিম থানার মোহা. আনারুল ইসলাম। মোখলেসুরকে সদরে, হুমায়নকে সলঙ্গায় ও আনারুলকে এনায়তেপুরে বদলি করা হয়েছে।
কোন ওসির বিরুদ্ধে কেমন অভিযোগ
গত বছরের ৪ মার্চ সিরাজগঞ্জ শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেল কলেজে শিক্ষার্থী আরাফাত আমিন তমালকে শ্রেণিকক্ষে গুলি করা হয়। এ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার এজাহারভুক্ত আসামি কুষ্টিয়ার ভেড়ামারার ‘অস্ত্র ও হত্যা মামলার আসামি’ এস এস আল হোসাইন সোহাগকে বাদ দিয়ে শিক্ষক শরিফ রায়হানকে একক অভিযুক্ত করা হয়। শ্রেণিকক্ষে গুলির ঘটনায় সিরাজগঞ্জের আদালতে সম্প্রতি অভিযোগপত্রও জমা দিয়েছে তদন্তকারী সংস্থা ডিবি পুলিশ। ওই ঘটনায় সমালোচিত হন ডিবির ওসি মো. একরামুল হোসাইন ও তদন্তকারী কর্মকর্তা নাজমুল হক।
শাহজাদপুরে চুনিয়াখালিতে চাঁদা দাবির ঘটনায় দিন-দুপুরে কাপড় ব্যবসায়ী হাজী মো. রায়হান বাবুকে মাদকসেবী কর্তৃক অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে জখম ও বেশ কয়েকটি চুরির ঘটনায় ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হওয়ায় আলোচিত হন ওসি আসলাম আলী। পাঁচ থানার ওসির একযোগে প্রত্যাহার-বদলি হলেও ডিবি পুলিশ ও শাহজাদপুর ওসির স্বপদে বহাল নিয়েও মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে।
সরকার পতনের পর সদর থানা এলাকায় মহল্লা-মহল্লায় দফায় দফায় সংঘর্ষ, খুন, ধর্ষণ-ডাকাতির একাধিক ঘটনা রয়েছে। বিচার প্রত্যাশীরা আসলেই নানা কায়দা-কৌশলে হয়রানি, জিডি-মামলা রেকর্ডে ঘুষ গ্রহণ, রিমান্ডের নামে নির্যাতন, পরে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে আসামিদের বিশেষ সুবিধা প্রদান, বিধি-বহির্ভূতভাবে আসামি ছেড়ে দিয়ে ‘সামারি বাণিজ্যের’ অভিযোগ উঠে বিতর্কিত সদর থানায় সাব ইন্সপেক্টর মনিরুল ও আব্দুর রাজ্জাকসহ কয়েকজন অসাধু পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। এসআই মনিরুল ও এসআই রাজ্জাককে অন্যত্র শাস্তিমূলক বদলি করা হলেও পরিস্থিতি এখনও উন্নতি হয়নি। বরং ‘ঘুষ-সামারি বাণিজ্য’ বহাল রয়েছে।
যমুনা সেতুর পশ্চিমে ঢাকা-রংপুর মহাসড়কের সয়দাবাদ গোলচত্বরে সাসেক-২ প্রকল্পের মীর আকতারের বেইস ক্যাম্প, কড্ডা, ঝাঐল ও কোনাবাড়িতে পাঁচটি ডাকাতির ঘটনা ঘটে। ২৪ এপ্রিল সয়দাবাদে ধাওয়া খাওয়া ডাকাত দলের ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে রফিকুল ইসলাম নামে পুলিশ কনস্টেবল প্রাণ হারান। এ ঘটনায় দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগ উঠে সেতু থানার ওসির বিরুদ্ধে।
এসএসসি পরীক্ষার হলে খাতা না দেখানোর জেরে সহপাঠীর মারপিটের দশ দিন চিকিৎসাধীন থেকে এনায়েতপুরে ইমন নামে এক শিক্ষার্থী গত ২৫ এপ্রিল মারা যান। ২২ এপ্রিল খুকনী গ্রামে তাঁত ব্যবসায়ী হাজী আবুল হোসেনের বাড়িতে চুরির ঘটনায় ৩৬ ভরি স্বর্ণালঙ্কার ও ৩৫ লাখ টাকা খোয়া যায়। ঘটনার সময় ওসি প্রশিক্ষণে থাকায় মামলা নেয়নি দায়িত্বরতরা। রোববার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশের ঊর্ধ্বতন মহলের সভায় চুরির ঘটনায় মামলা না নেওয়ার বিষয়টি উত্থাপন হলে কপাল পোড়ে ওসি ইয়াজদানীর।
রায়গঞ্জের চান্দাইকোনা ইউনিয়নের সোনারাম গ্রামে ‘আরাফাত-শরীফের ব্যক্তিগত বন্দিশালায়’ আব্দুল জাব্বার ও শিল্পী খাতুন নামে নিরীহ দুই গ্রামবাসীকে ছয় মাস জিম্মি রাখা হয়। জমিজমা ও আর্থিক সুবিধা হাতিয়ে নিতে ব্যর্থ হওয়ায় লক্ষীকোলার পল্লী চিকিৎসক নাজমুল হোসেন আরাফাত ও মেম্বর শরীফুল ইসলাম শরীফ গং তাদের জিম্মি করে রাখে। গত ২ মে ভোর রাতে তারা নিজ প্রচেষ্টায় মাটি খুঁড়ে মুক্ত হন জাব্বার ও শিল্পী। ওই ঘটনায় আগেও দু’টি জিডি করা হয়। আব্দুল জাব্বারের ছেলে শফিকুল ইসলাম আরাফাতকে সন্দেহভাজন হিসেবে অভিযুক্ত করে মামলা দিতে গেলেও গত ছয় মাস আগে আমলে নেয়নি রায়গঞ্জ পুলিশ। জিম্মি ও নির্যাতনের ঘটনায় ভুক্তভোগীর স্বজনদের পক্ষ থেকে ২০ জনকে নামীয় এবং অজ্ঞাত আরও ১২-১৩ জনকে আসামি করে নতুন আরও দু’টি মামলা করা হয়। ঘটনার পর আরাফাত ধরা পড়লেও মূল মাস্টারমাইন্ড শরীফুল ইসলাম মেম্বরসহ বাকীরা এখনও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে।
এদিকে, সলঙ্গার চড়িয়াকান্দি গ্রামে অভিযুক্ত বাবা জমশেদ ফকির ও তার ছেলে মুক্তা ফকিরের নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার স্থানীয় এক গৃহপরিচারিকার দু’মাসের গর্ভবতী হওয়ার ঘটনার বিপরীতে ব্যবস্থা নিতে পুলিশের গড়িমসির ঘটনাও রয়েছে।
এনায়েতপুর থানার সাবেক ওসি রওশন ইয়াজদানী মঙ্গলবার বলেন, গত ৪ আগস্ট সরকার পতনের আন্দোলনের সময় এনায়েতপুর থানায় অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও ভাংচুরসহ ১৫ জন পুলিশ সদস্যকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। গত আট মাস আগে দায়িত্ব নিয়ে বিধ্বস্ত থানা নতুন করে গড়ে তুলি। জানামতে আমার কোনো দায়িত্ব অবহেলা নেই।
রায়গঞ্জ থানার ওসি মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান বলেন, দু’জনকে জিম্মি বা বন্দি করে রাখার ঘটনার মামলায় পল্লী চিকিৎসক আরাফাত ছাড়া আর কেউ ধরা পড়েনি।
যমুনা সেতু পশ্চিম থানার ওসি আনারুল ইসলাম বলেন, ঈদের আগে কয়েকটি ডাকাতির ঘটনা ঘটলেও পরবর্তীতে মহাসড়কে বেশ উন্নতি হয়েছে।
বিচার প্রত্যাশীদের নির্যাতন, ঘুষ ও সামারি বাণিজ্যের বিষয় অস্বীকার করে সদর ওসি হুমায়ন কবির বলেন, যোগদানের আগেই সাব ইন্সপেক্টর মনির ও রাজ্জাক থানায় কর্মরত ছিলেন। ওসি হিসেবে যোগদান করার আগে থেকেই ওই থানার সবকিছু অবগত ছিলাম না। চার মাস আগে মনির-রাজ্জাক থানা থেকে বদলি হয়ে গেছেন।
সিরাজগঞ্জ পুলিশ সুপার মো. ফারুক হোসেন দাবি করেন, পুলিশ কর্মকর্তাদের বদলি বা প্রত্যাহারের বিষয়টি চাকরিরই অংশ।