
নিজেস্ব প্রতিবেদক:
আমাদের প্রতিদিনের খাবারে ঢুকিয়া পড়িতেছে প্লাস্তিক-এমন খবর আর নূতন নহে। সাম্প্রতিক সময়ে বেশ জোরেশোরে বলা হইতেছে যে, অনিয়ন্ত্রিত প্লাস্টিকের বর্জ্য প্রতিনিয়ত নদনদী, জলাভূমিতে গিয়া পড়িতেছে। মাছ সেই সকল খাইতেছে, আর মাছের মাধ্যমে তাহা মানুষের ফুড-চেইনে ঢুকিয়া পড়িতেছে। শুধু মাছ নহে, ইহা পানি, লবণ, চিনি, আটা, বাতাস প্রভৃতিতেও মিশিয়া যাইতেছে। এমনকি ইহার অস্তিত্ব মাতৃদুগ্ধ ও মানবভ্রূণ-শুক্রাণুতেও মিলিতেছে। এই কারণে প্লাস্টিক আজ বিশ্বব্যাপী এক মহা আতঙ্কের নাম!
গতকাল ছিল বিশ্ব ধরিত্রী দিবস। দিবসটির এই বারের প্রতিপাদ্য ছিল-‘আমাদের শক্তি, আমাদের পৃথিবী’। এই দিবসে মাটি তথা পরিবেশ ও স্বাস্থ্যগত বিপর্যয়ের বিষয়টি অধিক আলোচিত হইয়াছে। বিশেষ করিয়া মাটি, পানি, খাবার হইতে দেহে মাইক্রোপ্লাস্টিকের প্রবেশ ও তাহার বিপজ্জনক পরিণতির বিষয়টি গুরুত্ব লাভ করিয়াছে। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা প্রাণ-প্রকৃতিকে নীরবে-নিভৃতে বিষাক্ত করিয়া তুলিতেছে; কিন্তু যেই হেতু ইছা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা, তাই ইহা লইয়া আমাদের তেমন মাথাব্যথা নাই বলিলেই চলে। যদিও দীর্ঘ মেয়াদে ইহা সমগ্র বিশ্বের জনাই ভয়াবহ ক্ষতিকর হিসাবে বিবেচ্য। মাইক্রোপ্লাস্টিকের আকার পাঁচ মিলিমিটারের চাইতে ছোট হয়। দিনের পর দিন শরীরে এই বিষ মিশিতে থাকিলে দেহে বাসা বাঁধে মরণব্যাধি। ইহার প্রতিরোধকল্পে বিশ্বের প্রথম দেশ হিসাবে বাংলাদেশ ২০০২ সালে পলিথিন ব্যাগ নিষিদ্ধ করে। পলিথিন আর প্লাস্টিকের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক সময়ে দেশ জুড়িয়া চলিতেছে অভিযানও। তাহার পরও এই পরিস্থিতির উন্নতি হইতেছে না।
ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ডের তথ্য অনুযায়ী প্লাস্টিক দূষণের কারণে প্রতি বৎসর ১ লক্ষ সামুদ্রিক প্রাণী মারা যাইতেছে। প্রতিদিন প্রায় ৭৩ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য শুধু বাংলাদেশের ভিতর দিয়াই সমুদ্রে গিয়া পড়িতেছে। পরিমাণের দিক হইতে ইহা বিশ্বে পঞ্চম। আন্তঃরাষ্ট্রীয় এক গবেষক দল দেখিতে পাইয়াছেন যে, ময়মনসিংহের পুরোনো ব্রহ্মপুত্র নদের প্রতি বর্গকিলোমিটার পানিতে ২৫ লক্ষাধিক ভাসমান কণা এবং তলদেশে প্রতি কেজি মাটিতে সাড়ে ৪০০ কণা মাইক্রোপ্লাস্টিকের অস্তিত্ব রহিয়াছে। এমনকি হাওরের ধানেও মাইক্রোপ্লাস্টিক থাকার কথা বলিতেছেন গবেষকরা। আবার গত বৎসরের এপ্রিলে যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের বিভাগীয় শহরে প্রতি গ্রাম ধুলায় ৫২টি, ঢাকায় প্রতি গ্রাম ধুলায় ১০৬টি মাইক্রোপ্লাস্টিক উড়িতেছে। কী ভয়াবহ এক চিত্র! এদিকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল পরিবেশ বিজ্ঞানীর গবেষণায় আমাদের ব্যবহৃত প্রতি কেজি লবণে আড়াই হাজারেরও অধিক প্লাস্টিকের কণা পাওয়া গিয়াছে। এই হিসাবে দেশের একজন মানুষ প্রতি বৎসর গড়ে প্রায় ১৩ হাজার মাইক্রোপ্লাস্টিক খাইতেছে। শুধু লবণ নহে, চিনি এমনকি টি-ব্যাগেও মাইক্রোপ্লাস্টিকের অস্তিত্ব মিলিতেছে। দেশের ৭৩ শতাংশ মাছে রহিয়াছে প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণা। ইহা ছাড়া ভূগর্ভস্থ পানিসহ কয়েক প্রজাতির ব্যাঙ সংগ্রহ করিয়া তাহাদের ৯০ শতাংশের পাচনতন্ত্রে পাওয়া গিয়াছে। মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি।
উপর্যুক্ত পরিস্থিতির মূল কারণ আমরা দৈনন্দিন যে প্লাস্টিক ব্যবহার করি, তাহা ব্যবস্থাপনার আওতায় নাই। এমতাবস্থায় প্লাস্টিকদূষণ রোধ করিতে হইলে কোম্পানিগুলির প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ লইতে হইবে। পলিথিন শপিং ব্যাগ বন্ধে তৈরি করিতে হইবে সামাজিক জাগরণ। প্লাস্টিক পণ্য ও পলিথিন ব্যাগসহ সকল অপচনশীল কঠিন বর্জ্যের ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপদ অপসারণের ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ কাম্য। অপচনশীল প্লাস্টিক বর্জ্যকে সংগ্রহ, পৃথকীকরণ ও প্রক্রিয়াজাত করার জন্য আধুনিক বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থা প্রবর্তন করা প্রয়োজন। প্লাস্টিক বর্জ্যকে রিসাইক্লিং বা পুনরাবর্তনের পদক্ষেপ গ্রহণ করিয়া পরিমাণ সীমিত রাখা সম্ভব। ইহার পাশাপাশি পলিথিন ব্যাগের বিকল্প হিসাবে কাপড় অথবা কম মূল্যে চটের ব্যাগকে জনগণের নিকট সহজলভ্য করিতে হইবে। ঘরে ঘরে মানুষকে কাচ, অ্যালুমিনিয়াম, সিরামিক ও মাটির বাসনকোসন ব্যবহারে অভ্যস্ত হইতে হইবে। ছুড়িয়া ফেলিতে হইবে প্লাস্টিকের তৈরি সকল পণ্য। এইভাবে প্লাস্টিকের পণ্য ব্যবহার বন্ধ হইলে প্লাস্টিক বর্জ্যের প্রভাবে পরিবেশ বিপর্যয় হইতে জনস্বাস্থ্য ও ধরিত্রীকে রক্ষা করা যাইবে।