পার্বত্য চট্টগ্রামের কৃষি উন্নয়নে ব্রি’র গবেষণা কার্যক্রম

প্রকাশিত: ৬:২১ অপরাহ্ণ, মে ১৫, ২০২৫

নিজস্ব প্রতিবেদক :

কৃষিই কৃষ্টির মূল। কৃষিতেই সমৃদ্ধি। আর সমৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন টেকসই কৃষি। টেকসই কৃষি উন্নয়ন মানে হচ্ছে দীর্ঘস্থায়ী ও সুষম উন্নয়ন। এর একটি প্রধান লক্ষ্য হলো ২০৩০ সালের মধ্যে ক্ষুধা নির্মূল করা এবং সবার জন্য খাদ্যের সরবরাহ নিশ্চিত করা। বিশেষ করে দরিদ্র মানুষের জন্য খাদ্য ও পুষ্টির সরবরাহ নিশ্চিত করা। এসডিজির শ্লোগান হচ্ছে ‘কাউকে পেছনে রেখে নয়’ অর্থাৎ সবাইকে নিয়ে সুষম উন্নয়ন। পার্বত্য চট্টগ্রাম দেশের এক দশমাংশ সুতরাং এই অংশকে উন্নয়নের বাইরে রেখে দেশের সুষম উন্নয়ন অসম্ভব। এই বিষয়টি উপলব্ধি করে পাহাড়ের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কার্যকর গবেষণা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট।

আমাদের এই দেশটির মোট আয়তনের শতকরা ১২ ভাগ পাহাড়ি এলাকা যার শতকরা ১০ ভাগ শুধুমাত্র রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান এই তিন পার্বত্য এলাকাজুড়ে অবস্থিত যার পরিমাণ প্রায় ১৩,২৯৫ বর্গ কিলোমিটার। এ অঞ্চলে বসবাসরত ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী আদিকাল থেকে পাহাড়ের গায়ে জুমচাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের আবহাওয়া ও মাটির বৈশিষ্ট্য জুমচাষের জন্য উপযোগী। এখানকার প্রায় ৪০ হাজার পরিবার প্রত্যক্ষভাবে জুমচাষের সাথে সম্পৃক্ত এবং এ অঞ্চলের আদিবাসীরা যুগ যুগ ধরে তাদের সুপ্রাচীন ঐতিহ্য ধরে রাখতে বংশ পরম্পরায় জুমচাষ করে আসছে। এটি এমন একটি ক্ষেত্র যেখানে নারী-পুরুষ উভয়েই সারাবছর বিভিন্ন কাজে আত্মনিয়োজিত থাকে। পাহাড়ের ঢালে একটা ধারালো দা দিয়ে ছোট ছোট গর্ত করে তার মধ্যে অনেক রকম ফসলের বীজ একসাথে মিশিয়ে বুনে আবাদ করা হয়। পাহাড়ের জঙ্গলাকীর্ণ জমির জঙ্গল কেটে রোদে শুকিয়ে তাতে আগুন লাগিয়ে নির্বাচিত জমিকে কৃষিজ উৎপাদনের আওতায় আনা হয়। আদি কৃষিপ্রথার এ পদ্ধতিকে এজন্য অনেকে জঙ্গল কাটা ও পোড়ানো কৃষি পদ্ধতি (ঝষধংয ধহফ নঁৎহ পঁষঃরাধঃরড়হ) হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। জুমচাষ একই জমিতে বছরের পর বছর ধরে অবিরামভাবে করা হয় না বিধায় একে স্থানান্তরিক কৃষি পদ্ধতিও (ঝযরভঃরহম পঁষঃরাধঃরড়হ) বলা হয়ে থাকে এবং যারা জুম চাষ করেন তাদের বলা হয় জুমিয়া।

জুম থেকে কম মুনাফা আসা সত্ত্বেও অধিকাংশ জুমচাষি তাদের জীবনধারণের জন্য আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে জুমের ওপর নির্ভরশীল। জুমিয়ারা জুমে একসঙ্গে প্রায় ৩০ থেকে ৩৫টি ফসলের আবাদ করে থাকে। অনেক জুমচাষি আবার তাদের জুমে মাত্র ১৭/১৮টি ফসলও করে থাকেন। জুমে তাদের এই উৎপাদন যজ্ঞ সাধারণত ডিসেম্বর- জানুয়ারি থেকে শুরু হয়ে অক্টোবর-নভেম্বর মাস পর্যন্ত চলে। এটা লক্ষণীয় যে, এখন পর্যন্ত ধান, সবজি, অর্থকরী ফসল, ফল, মসলা ইত্যাদির জন্য বছরের বেশিরভাগ সময় জুমিয়ারা জুমের ওপর নির্ভরশীল। এ কারণেই পাহাড়ি এলাকার স্থানীয় জনগণ জুমচাষকেই খাদ্য ও জীবন রক্ষার একমাত্র অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করেছে। বর্তমানে জুমের পতিত জমি থেকে তারা আদা, হলুদ, মরিচ ইত্যাদির চাষ করছে। এক সময় জুমিয়ারা জুম হতে সারা বছরের প্রয়োজনীয় খোরাকি জোগাড় করতে সক্ষম হতো। এমনকি পরিবারের ভরণ-পোষণের পর যে খাদ্য উদ্বৃত্ত থাকতো তা বিক্রি করে পরিবারের অন্যান্য প্রয়োজন মেটাতেন। কিন্তু জুমিয়াদের মতে আজকাল জুমচাষ আর আগের মতো নেই-ফলন ভাল হয় না। এক বছর জুমচাষ করার পর ৮-১০ বছর জমিটি পতিত রাখা প্রয়োজন। এতে করে জুম চাষের জমিটির উর্বরতা পুনরুদ্ধার হয়। কিন্তু জনসংখ্যার চাপে জুমচাষের পরিমাণ ক্রমান্বয়ে সংকুচিত হয়ে আসছে এবং জমিটিও আগের মতো অধিক সময় পতিত রাখা যায় না। বলাবাহুল্য, জুমিয়ারা হচ্ছেন সবাই প্রান্তিক চাষি ও সাধারণভাবে হতদ্ররিদ্র। অধিকাংশ জুমিয়ারা খাদ্যাভাব ও অপুষ্টিতে ভোগে। তারা হচ্ছেন গ্রামীণ সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত অংশ যারা অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে সৃষ্ট বিরূপ পরিস্থিতির শিকার। জুমচাষ করা ছাড়া অন্য কোনোভাবেই তাদের টিকে থাকারও উপায় নেই। বৈজ্ঞানিকভাবে জুমচাষ ভূমিক্ষয় ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হওয়া সত্ত্বেও বিকল্প কর্মসংস্থানের অভাবে পাহাড়ি জনগোষ্ঠী এখনো তাদের ঐতিহ্য জুমচাষ ধরে রেখেছেন।

পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলাতে চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, লুসাই, পাংখো, বম, ম্রো, খিয়াং, খুমি, চাকসহ ১১টি নৃ-গোষ্ঠীসহ বাঙালিরা বসবাস করে আসছেন যাদের প্রধান পেশা কৃষি। এসব অঞ্চলের জুমচাষিরা সনাতন পদ্ধতিতে জুমচাষ করে থাকে। এছাড়া উপযুক্ত উচ্চফলনশীল জাত ও উৎপাদন উপকরণ সঠিক মাত্রায় ব্যবহার না করার কারণে তারা কাঙ্ক্ষিত ফলন পায় না। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, জুমচাষিদের জুমে উৎপাদিত ধানে তাদের বছরের মাত্র ৫-৭ মাস চলে। বাকি ৭-৫ মাসের খাদ্যের সংস্থানের জন্য বিভিন্ন কাজকর্ম যেমন-বয়ন, হস্তশিল্প, দিনমজুরি, রাজমিস্ত্রি, গাড়ি চালনা, নার্সারি ইত্যাদি কাজ করে অত্যন্ত কষ্টে দিনাতিপাত করতে হয়। অনুকূল পরিবেশ এলাকার মতো পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সারাবছরের খাদ্যের যোগান নিশ্চিত করতে এবং জুমচাষ পদ্ধতি উন্নয়নের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট সীমিত পরিসরে “পাহাড়ি অঞ্চলে নেরিকাসহ অন্যান্য উন্নত ধানের জাতের গ্রহণযোগ্যতা ও লাভজনক হিসাব নির্ধারণ” কর্মসূচির অর্থায়নে পার্বত্য তিন জেলার বিভিন্ন উপজেলায় পাহাড়ের ঢালে তথা জুমে এবং পাহাড়ের পাদদেশে সমতলে তিন বছরে (জুলাই ২০১৭-জুন ২০২০) গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করেছে এবং বর্তমানে রাজস্ব অর্থায়নে উক্ত গবেষণা কাজ অব্যাহত রয়েছে।পাহাড়ি বিশাল এলাকাকে খাদ্য উৎপাদনের যথাযথ অংশীদার করার লক্ষ্যে জুমে পাহাড়িদের প্রচলিত সিস্টেমকে বিঘ্নিত না করে তাদের স্থানীয় জাতের পাশাপাশি ব্রি উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল আধুনিক আউশ বিআর২৬, ব্রি ধান৪৮, ব্রি ধান৮২, ব্রি ধান৮৩ এবং ব্রি ধান৮৫ ধানের জাতের চাষ করছে এবং কৃষকেরা জাতগুলোর তুলনামূলক উচ্চফলনশীলতার জন্য গ্রহণ করেছে। ব্রি উদ্ভাবিত আধুনিক উচ্চফলনশীল জাতের গড় ফলন প্রতি হেক্টরে ৩.৫০ টন যেখানে তাদের চাষকৃত স্থানীয় জাতের গড় ফলন প্রতি হেক্টরে ২.০ টন। আউশ মৌসুমে জুমে সম্প্রতি উদ্ভাবিত ব্রি ধান৯৮ এবং ব্রি হাইব্রিডধান৭ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সাধারণত জুমচাষে জুমিয়ারা কোন সার ব্যবহার করেনা। কিছু কিছু প্রগতিশীল কৃষক কিছু ইউরিয়া সার ব্যবহার করলেও তা আবার কার্যকর ও বিজ্ঞান সম্মতভাবে করে না। সে প্রেক্ষিতে চাষকৃত ধানের পুষ্টি উপাদান সরবরাহের লক্ষ্যে সার ব্যবস্থাপনার ওপর গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে এবং সঠিক সার প্রয়োগ পদ্ধতিও উদ্ভাবন করা হয়েছে।

পাহাড়ি জনগণ সাধারণত রান্নায় তেল ব্যবহার করেনা। ফলে তারা তেলে দ্রবণীয় ভিটামিন যেমন- ভিটামিন এ, ডি, ই, কে এর ঘাটতিতে ভোগেন। ভিটামিনের ঘাটতিজনিত সমস্যা দূরীকরণ এবং পাশাপাশি উৎপাদন প্রক্রিয়ার উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর জন্য লাগসই ধানভিত্তিক শস্য বিন্যাস উন্নয়নের জন্য গবেষণা কাজ পরিচালিত হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় পাহাড়ের পাদদেশে সমতলে রোপা আমন-বোরো শস্য বিন্যাসে সম্প্রতি উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল উন্নত ধানের জাত প্রতিস্থাপনসহ অন্তর্র্বতীকালীন সময়ে সরিষা অন্তর্ভুক্তিকরণের মাধ্যমে মোট উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে গবেষণা কার্যক্রম সম্পাদন করা হচ্ছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ের পাদদেশের ১৭,৬১০ হেক্টর সমতল জমিতে মূলত একটি মাত্র ফসল রোপা আমন চাষ করা হয় যা সম্পূর্ণ বৃষ্টি নির্ভর। ইদানীং কিছু কিছু এলাকায় রোপা আমন চাষের আগে পাহাড়ি এলাকার কৃষক ছরার পানি ব্যবহার করে স্থানীয় জাতের আউশ আবাদ করে থাকে যার ফলন তুলনামূলকভাবে কম। এসব অঞ্চলে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের মাধ্যমে উচ্চফলনশীল আউশ অন্তর্ভুক্ত করে ফসলের মোট উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করা হচ্ছে। বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট কর্তৃক প্রবর্তিত জুমে এবং সমতলে কৃষকের কাছে ব্ল্যাকরাইস গ্রহণযোগ্য হয়েছে। তাদের ভাষ্যমতে, এ জাতটি তাদের স্থানীয় বিন্নি জাতের মতো আঠালো এবং হালকা অ্যারোমা আছে। উপরন্তু, বিন্নির চেয়ে ফলন বেশি এবং তিন মৌসুমেই করা যায়। চাহিদা থাকায় বোরো মৌসুমেও চাষাবাদের জন্য পরীক্ষণ স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া ব্রি সম্প্রতি উদ্ভাবিত উচ্চফলনশীল বিভিন্ন মৌসুমের জাতসমূহ পাহাড়ি পরিবেশ উপযোগী ট্রায়ালের মাধ্যমে উপযোগিতা যাচাইয়ের কাজ করছে।

জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ করার স্বার্থে পরিবেশবান্ধব উৎপাদন প্রক্রিয়া অর্থাৎ জুমের প্রাচীন যে চাষ পদ্ধতি তা অনুসরণ করার মাধ্যমে পাহাড়ে জমির স্বাস্থ্য সুরক্ষার পাশাপাশি নৃ-গোষ্ঠীকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার জন্য বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট ফার্মিং সিস্টেমস গবেষণার মাধ্যমে জুম চাষের পাশাপাশি উচ্চ মূল্যমানের সম্ভাবনাময় ফল-ফসল ড্রাগনফ্রুট, খেজুর, অ্যাভোকোভা, কফি, কাজুবাদাম ইত্যাদি চাষের পরিকল্পনা করছে যাতে প্রত্যন্ত ও দুর্গম এলাকায় বসবাসরত জুমিয়াদের গ্রামীণ জীবন-জীবিকার প্রকৃত উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব হয়। সবাইকে নিয়ে সুষম উন্নয়নের জন্য পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্রি’সহ সকল সরকারি-বেসরকারি সংস্থার সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।