
নিজেস্ব প্রতিবেদক:
উন্নত বিশ্বের সাথে তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহের মৌলিক পার্থক্য এই যে, তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে রাজনীতি সর্বক্ষেত্রে উপস্থিত থাকে। ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাবে সেখানে শিক্ষক রাজনীতি আছে। কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষক রাজনীতির প্রভাব অনেক বেশি। কোন নাগরিক স্বাস্থ্যসেবা পাবে, কোন নাগরিক স্বাস্থ্যসেবা পাবে না, সেটা সেই স্থানীয় রাজনীতি ধারা সীমাব্ধ করা আছে। জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট থেকে শুরু করে যাবতীয় নাগরিক জীবনের যে সার্টিফিকেশন, সেই সার্টিফিকেশন পেতে সরকারি দপ্তরে সকলকে হানা দিতে হয়। জনসাধারণকে সরকারি অফিস সার্টিফিকেট পেতে বিপুল পরিমাণ দুর্নীতির আশ্রয় প্রশ্রয় মেনে নিতে হয়। টাকা ছাড়া অথবা দলীয় প্রভাব ছাড়া অথবা ক্ষমতাশীন কারোর কাছে থেকে আনুগত্য প্রকাশ ছাড়া এসব সার্ভিস পাওয়া সাধারণ নাগরিকের জন্য দুষ্কর হয়ে পড়ে। একই সাথে স্বজনপ্রীতি, দলীয় রাজনীতির ব্যবহার, অঞ্চলপ্রীতি, আত্মীয়স্বজনের কাছে থেকে তাদের সঙ্গ লাভ অথবা দলীয় ক্যাডার ব্যবহার করে সর্বত্র দেশের রাজনীতিকে যেভাবে কলুষিত করা হয়েছে, সেখানে সাধারণ মানুষের পক্ষে রাজনীতি পরিচয়ের বাইরে সব রকমের নাগরিক সেবা পাওয়া এক ধরণের দুষ্কর।
নাগরিক জীবনের সব কিছু রাজনীতির মধ্যে নিয়ে আসা উন্নয়শীল বিশ্বের জন্য এক বড় রকমের মাথা ব্যথা। সেইসব দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন, অর্থনৈতিক উন্নয়নকে রাজনৈতিক বিবেচনায় সম্পন্ন করার দরুন তৃতীয় বিশ্বের দেশের নাগরিকেরা নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত। অন্য দিক, বাংলাদেশের মত দেশে সব রকমের উন্নয়ন প্রকল্প যা যা ইতো মধ্যে হয়েছে, সেগুলো হয়েছে আবার রাজনৈতিক বিবেচনায়। ফলে নাগরিক সুবিধার জন্য যে ধরনের প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেসব প্রতিষ্ঠান আসলে নাগরিকদের সেবা দিয়ে থাকে তার সাথে কোন দলের সংগঠন বা রাজনৈতিক দলের সাথে তাদের যোগাযোগ রক্ষা বা অর্থকড়ির বিনিময়ে। মোটা দাগে যাকে আর্থ-সামাজিক দুর্নীতি বলে আখ্যায়িত করা যায়। সে সব দেশে এমন লোক খুবই কম আছে যিনি সরকারি অফিসে গিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্রের কাজটি অথবা পাসপোর্টের কাজটি রাজনৈতিক যোগাযোগ ব্যতীত বা অর্থকড়ির বিনিময় ছাড়া খুব সহজেই করে ফেলতে পেরেছেন। এমন সংখ্যা যে নেই! তা না আছে, কিন্তু সেটা খুবই নগণ্য। গড়পড়তা শতকরা ৮০ ভাগের মানুষকে অর্থ দিয়ে অথবা ক্ষমতাশীন কোন মানুষের পরিচয় ব্যবহার করে এইসব নাগরিক কাগজপত্র ম্যানেজ করতে দেখা যায়। রাজনীতি হচ্ছে সেসব দেশের জন্য প্রধান চরিত্র। রাজনীতির বাইরে কোন ব্যক্তিবর্গ কোনো রকম নাগরিক সুবিধা পান না বা পাওয়ার সংস্কৃতি তৈরি হয়নি। এটা এক অর্থে উন্নত বিশ্বের সাথে উন্নয়শীল বিশ্বের মৌলিক তফাৎ।
ইউরোপ আমেরিকার মতো দেশগুলোতে নাগরিক সুবিধা যে কেউ পেতে পারে অথবা একজন মানুষের সব রকমের নাগরিক সুবিধা দরকার। একজনের হয়তো জন্ম সনদ দরকার, পাসপোর্ট দরকার, হয়তো খাদ্য কর্মসূচির অংশ হওয়া দরকার। অথবা একজন ব্যক্তি নিম্ন আয়ের মানুষ হলে তাকে যেকোনো সরকারি দপ্তরে গিয়ে আবেদনের প্রেক্ষিতে তার ঘরে খাদ্য সংস্থানের আয়োজন হয়তো পূরন হওয়া সম্ভব। সেখানে কোনভাবে রাজনৈতিক পরিচয় মুখ্য বিষয় নয়। যে কোন নাগরিক সুবিধা পাওয়ার ক্ষেত্রে তার নাগরিক পরিচিতিই যথেষ্ট। রাজনৈতিক পরিচিয় সেখানে গৌণ।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে উন্নত বিশ্বে নাগরিক সুবিধা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে রাজনীতিকরণ হচ্ছে। বিশেষ করে উন্নত বিশ্বে অভিবাসন গ্রহণকারী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে রাজনীতিকরণের মাত্রা অনেক বেড়ে গিয়েছে। উন্নত বিশ্বের নাগরিক হতে আসা যে কোন মানুষকে দীর্ঘমেয়াদি বসবাসের পরিবেশ তৈরি করতে সেসব দেশের রাজনীতিকরণের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। ফলে যে অভিযোগ আমরা করছিলাম, তৃতীয় বিশ্বের দেশে রাজনীতি ছাড়া কোনো রকমের নাগরিক সুবিধা বা নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা যায় না। এখন দেখা যাচ্ছে যে, তৃতীয় বিশ্বের “সব কিছুর মধ্যে রাজনীতি থাকতে হবে” এমন পরিকল্পনা উন্নত বিশ্বের কাছে হস্তান্তর হয়েছে। তৃতীয় বিশ্বের মত উন্নত বিশ্বও এখন নাগরিক পরিচয়ের ক্ষেত্রে, নাগরিক সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে রাজনীতিকে প্রধান কেন্দ্রবিন্দুতে রুপান্তরিত করার চেষ্টা করছে।
তৃতীয় বিশ্ব থেকে উন্নত বিশ্বে আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল যেসব মানুষ অভিবাসী হিসেবে ইউরোপ, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ায় এসেছে, তাদের সেইসব থাকবার জন্য সুযোগ সুবিধা প্রতিষ্ঠা করবার জন্য এক ধরনের আইনকানুন বিগত বছর ধরে প্রচলিত ছিল।
উন্নত বিশ্বে সাম্প্রতিক সময়ে এমন এক উগ্র ধানপন্থি রাজনীতির প্রচলন হয়েছে, সেই রাজনীতিতে অভিবাসীদের সুরক্ষায় জন্য যে সব আইনকানুন ছিল, সে সব আইনকানুন ভেঙ্গে দিয়ে নতুন করে এমন এক বিশ্ব তৈরি করার চেষ্টা করছে, যেখানে রাজনীতির বাইরে কোনকিছু কে স্থান দেওয়ার সুযোগ হচ্ছে না। ফলে যেটা দেখা গেল যে সাম্প্রতিক সময়ে ডোনাল্ট ট্রাম্প যে আমেরিকাতে রাষ্ট্রপ্রতি হয়ে এসেছেন, সেই রাষ্ট্রপ্রতি এদেশের কোটি জনসাধারণকে প্রত্যক্ষভাবে আক্রান্ত করছে।
মার্কিন দেশে কয়েক কোটি অবৈধ নাগরিক রয়েছে যারা নানা সময় সে দেশে পাড়ি দিয়েছে। অবৈধ এই অর্থে যে, এদেশে থাকার বৈধ কাগজপত্র তাদের হাতে নাই। কিন্তু তাদের কাজকর্ম, তাদের নাগরিক হিসেবে এখানে অংশগ্রহণ সেটা কোনোভাবেই আবার নেতিবাচক নয়। তৃতীয় বিশ্ব থেকে আসা এইসব “অবৈধ” নাগরিক আমেরিকার উন্নতির জন্য দিনরাত পরিশ্রম করে যাচ্ছে। আর্থসামাজিক ভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে স্বাবলম্বি করে যাচ্ছে। তারা কাগজপত্র নিয়ে আসে নাই কিন্তু এখানে অপরাধের সাথে সম্পৃক্ততা একেবারেই নেই। তারা খুবই স্বল্প মূল্যে এদেশের আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। এদেশের কৃষির উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। বলা যায়, যত প্রকার কায়গিক শ্রম নির্ভর কর্মসস্থান আছে, তার সর্ব ক্ষেত্রে শ্রমিকের যোগান এই ‘অবৈধ’ অভিবাসীদের মাধ্যমেই হচ্ছে। মার্কিন দেশের সকল রকমের নিম্ন আয়ের কর্মসংস্থান, খাবার হোটেল, গ্যাস স্টেশন থেকে শুরু করে বড় বড় সুপার মার্কেটে তারা দক্ষতার সাথে দিনের পর দিন কাজ করে যাচ্ছে। এদেশের প্রত্যেকটি বিদ্যালয়, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা প্রহরী থেকে শুরু করে যারা ক্লিনার ছিলো তারা প্রত্যেকেই দক্ষতার সাথে এদেশের উন্নয়নে অবদান রেখে চলেছে। কিন্তু যে ধরনের রাজনীতি সাম্প্রতিক সময়ে সমগ্র ইউরোপে, আমেরিকায়, কানাডাতে ও অস্ট্রেলিয়ায় শুরু হয়েছে সেই রাজনীতিতে দেখা যাচ্ছে যে, এই নিম্ন আয়ের মানুষদের আক্রান্ত করার দিকে নজর দেওয়া হচ্ছে। নিম্ন আয়ের মানুষের যে জীবিকা তাকে রাজনৈতিক মানদন্ডে দেখার রাস্তা তৈরি হচ্ছে। ফলে ডোনাল্ট ট্রাম্পকেও তার রাষ্ট্রপ্রতি হওয়ার শুরুতেই অনেকগুলো বিষয়ে স্বাক্ষর করতে দেখা গেছে যেগুলো প্রকৃতপক্ষে এদেশের শ্রমিক শ্রেণি ও নিম্ন আয়ের মানুষ যাদের আসলে কোনোরকম রাজনৈতিক পরিচয়ের বাইরে গিয়ে এদেশের বসবাস করার যে পরিবেশ ছিল সেই পরিবেশ হুমকির মুখে ফেলছে।
তৃতীয় বিশ্বের একজন সাধারণ নাগরিক হিসেবে আমাদের এক ধরনের বোঝাপড়া ছিল যে উন্নত দেশগুলো সাধারণ মানুষকে তার রাজনৈতিক কাঠামোর বাইরে রেখে দেশ চালায়- সে অণুসিদ্ধান্ত থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করছি বা বের হতে হচ্ছে। যেভাবে হিসেব করেছিলাম যে বাংলাদেশের একজন নাগরিক হিসেবে জাতীয় পরিচয়পত্র, পাসপোর্ট থেকে শুরু করে সবরকমের নাগরিক পরিচিতি অথবা স্বাস্থ্যসেবা অথবা পুলিশি নিরাপত্তা বা আইনগত সাহায্য পাবার অধিকার অথবা স্থানীয় বিদ্যুৎ সুবিধা পেতে যে ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়; এইসব নাগরিক সুবিধা পেতে রাজনৈতিভাবে পরিচিতির দরকার হয়। অথবা দুর্নীতির আশ্রয় নিতে হয়। আমেরিকাতে এসে সেই পর্যায়ের না হলেও সব ধরনের স্বাস্থ্যসেবা, নাগরিক অধিকার প্রাপ্তদের রাজনীতির মধ্যে নিয়ে আসার রাষ্ট্রীয় কাঠামো ক্রমশও জন্ম লাভ করছে।
ফলে মোটা দাগে এই কথা দাঁড়াচ্ছে যে, সারা বিশ্বে যে ধরনের রাজনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে; এই সংকটের মধ্যে সাধারণ মানুষ যে কোনো ভাবেই রাজনীতির বাইরে থেকে নাগরিক জীবনযাপন করার চেষ্টা করছিল। বলা যায় রাজনীতিকে এক ধরনের সংকট মনে করে রাজনীতির বাইরে থেকে জীবনযাপন করার চেষ্টা করছিল। এখন দেখা যাচ্ছে আমেরিকা, ইউরোপ বা উন্নত বিশ্ব সেই রাজনীতির মধ্যে জনগনকে বার বার টেনে আনার চেষ্টা করছে। এতে করে সারা বিশ্বে রাজনীতির প্রতি সাধারণ মানুষের যে ধরনের মনোভাব রয়েছে সেটি কোনদিকে নিয়ে যায় সেটি সকলকে ভাবাচ্ছে। রাজনীতির বাইরে গিয়ে আধুনিক বিশ্ব নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে পারে কিনা সেটিও নির্ভর করছে বিশ্বনাগরিক মহলে নতুন রাষ্ট্র পদ্ধতির সূচনা হবে কিনা তার উপর।
নিয়ামত আলী: গ্র্যাজুয়েট টিচিং অ্যাসিস্ট্যান্ট, ফ্লোরিডা আটলান্টিক ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র