পাকিস্তানের বাদশা ফয়সাল মসজিদ যেভাবে নির্মিত হয়েছে

প্রকাশিত: ১২:৪৬ অপরাহ্ণ, মে ৮, ২০২৫

ডেস্ক রিপোর্ট:

বিশ্বের বৃহত্তম মসজিদগুলোর একটি পাকিস্তানের ইসলামাবাদে অবস্থিত বাদশা ফয়সাল মসজিদ। গিনেস বুক অফ রেকর্ডসের ১৯৯২ সালের সংস্করণে এই মসজিদকে বিশ্বের বৃহত্তম মসজিদ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। মসজিদটি নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল ১৯৬০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ে। ১০ বছরের বেশি এর নির্মাণ কাজ চলমান ছিল।

পাহাড়ের পাদদেশে মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা

১৯৬০ এর দশকে ইসলামাবাদে পাকিস্তানের নতুন রাজধানী তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই সময় পাকিস্তান সরকার নতুন রাজধানীতে মার্গালা পাহাড়ের পাদদেশে একটি মসজিদ নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী মসজিদটি শুধু ইসলামাবাদ শহরের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু হবে না, বরং পাকিস্তানের বিশেষ পরিচয়ও বহন করবে।

১৯৬৬ সালের ১৯ এপ্রিল সৌদি আরবের বাদশাহ ফয়সাল বিন আব্দুল আজিজ ছয় দিনের সফরে পাকিস্তানে আসেন। এই সফরে তিনি ইসলামাবাদ যান।

বাদশাহ ফয়সাল যখন মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা জানতে পারলেন

ইসলামাবাদে অবস্থানকালে তিনি শাকারপারিয়ান পাহাড়ে একটি চারা রোপণ করেন। এ সময় পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ বাদশাহ ফয়সাল বিন আব্দুল আজিজকে ইসলামাবাদে একটি বিশাল মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনার কথা জানায়।

পরিকল্পনার কথা জানতে পেরে বাদশাহ ফয়সাল নির্মাণে অংশ গ্রহণ ও সমস্ত ব্যয় বহনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। পাকিস্তান সরকার তার প্রস্তাব গ্রহণ করে।

মসজিদের নকশা তৈরির প্রতিযোগিতা

মসজিদটি নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়ার সময় পাকিস্তান সরকার একে বিশ্বের বুকে পাকিস্তানের জন্য একটি আইকন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। তাই সরকার এই মসজিদটির নকশা তৈরির জন্য একটি আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা আয়োজনের সিদ্ধান্ত নেয়।

আন্তর্জাতিক সিভিল ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের তত্ত্বাবধানে সিডিএ এবং পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অফ সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং এই প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য শুধুমাত্র মুসলিম স্থপতিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল।

প্রতিযোগিতায় পাকিস্তান, তুরস্ক, মিশর, সৌদি আরব, ইন্দোনেশিয়া, ইরান, মালয়েশিয়া, আফগানিস্তান, সিরিয়া, লিবিয়া, মরক্কো, ইরাক এবং যুগোস্লাভিয়া-সহ ১৩টি দেশ থেকে ৩৯টি মানচিত্র গ্রহণ করা হয়েছিল। মানচিত্রগুলো পরীক্ষা করার জন্য ১৯৬৯ সালের ১৭ নভেম্বর একটি জুরি সভার আয়োজন করা হয়।

জুরি বোর্ডে পাকিস্তান, তুরস্ক এবং লেবাননের স্থপতিরা ছিলেন, এবং সিডিএ চেয়ারম্যান জেনারেল কেএম শেখ জুরি বোর্ডের সভাপতি ছিলেন।

তুর্কি স্থপতি

১৯৬৯ সালের ২০ নভেম্বর সিডিএ-এর এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ইসলামাবাদে জাতীয় মসজিদের (পরবর্তীতে ফয়সাল মসজিদের নামকরণ করা হয়) নকশার জন্য আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় প্রখ্যাত তুর্কি স্থপতি বেদাত দিলুক জয়ী হয়েছেন। জুরি বোর্ড সর্বসম্মতিক্রমে তুর্কি স্থপতি বেদাত দিলুকের নকশাকে প্রথম স্থান প্রদান করে।

প্রতিযোগিতায় তুরস্কের দুই স্থপতি, জনাব চেঙ্গিজ উজাইর এবং জনাব নিহাত বান্দওয়ালের নকশা যথাক্রমে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্থানের যোগ্য ঘোষণা করা হয়।

এম. হানিফ রাজা লিখিত ‘ফয়সাল মসজিদ ইসলামাবাদ’ বইতে বলা হয়েছে, এই নকশা অনুযায়ী মসজিদটি নির্মাণ করা খুবই কঠিন কাজ ছিল, কিন্তু পাকিস্তানি নির্মাণ সংস্থা পাকিস্তান ন্যাশনাল কনস্ট্রাকশন কোম্পানি এই চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে।

বাদশাহ ফয়সালের মৃত্যু ও মসজিদের নামকরণ

১৯৭৫ সালের মার্চ মাসে বাদশাহ ফয়সাল বিন আব্দুল আজিজকে হত্যা করা হয়েছিল। তার মৃত্যুর পর পাকিস্তান সরকার এই মসজিকে তার নামেই নামকরণের সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৭৫ সালের ২৮ নভেম্বর এই মসজিদের নাম ‘বাদশা ফয়সাল মসজিদ’ ঘোষণা করা হয়।

মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন

১৯৭৬ সালের অক্টোবরে সৌদি আরবের বাদশাহ খালিদ বিন আব্দুল আজিজ পাকিস্তান সফর করেন। পাকিস্তান সরকার তাকে তার ভাইয়ের নামে নামকরণ করা এই মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের অনুরোধ জানিয়েছিল। ১৯৭৬ সালের ১২ অক্টোবর, বাদশাহ খালিদ এক জাকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানে এই মসজিদের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।

বাদশা ফয়সাল মসজিদে প্রথম জুমার নামাজ

১৯৮৩ সালের ২৮ জানুয়ারী ইসলামাবাদের ফয়সাল মসজিদে প্রথম জুমার নামাজ আদায় করা হয়। নামাজের ইমামতি করেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিন মাওলানা হুসাইন আহমেদ হাসান।

১০ বছর ধরে দিন-রাত নির্মাণ কাজ চলমান ছিল। ১৯৮৬ সালের ২ জুন (১৪০৬ হিজরির ২৩ রমজান) এর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়। ১৯৬৬ সালে বাদশাহ ফয়সাল যে স্বপ্ন দেখেছিলেন তা দুই দশক পরে বাস্তবে পরিণত হয়।

মসজিদের আয়তন ও অন্যান্য

বাদশা ফয়সাল মসজিদ ৪৬ একর জমির উপর নির্মিত হয়েছে। মসজিদের মূল হলের আয়তন ৮২,৯৪৪ বর্গফুট। মসজিদের কেন্দ্রীয় হলটি চারটি মিনারে বেষ্টিত, প্রতিটি মিনার ২৮৫ ফুট উঁচু।

মসজিদের প্রধান হলটি একটি তাঁবুর আকৃতিতে তৈরি, যার ভিতরের দিকে উচ্চতা ১৪০ ফুট এবং বাইরের দিকে ১৫০ ফুট। এই কেন্দ্রীয় হলটিতে, দুইজন বিশিষ্ট পাকিস্তানি চিত্রশিল্পী, সাদেকীন এবং গুলজি, কোরআনের আয়াতের ক্যালিগ্রাফির কাজ করেছেন।এছাড়াও গুলজি এই হলের উপরে স্থাপিত সোনালী অর্ধচন্দ্রের স্থাপনের কাজও করেছিলেন।

মসজিদের পূর্ব দেয়াল বরাবর নারীদের জন্য একটি আলাদা গ্যালারি তৈরি করা হয়েছ। এই গ্যালারিতে প্রায় দুই হাজার নারী একসাথে নামাজ পড়তে পারেন।

গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস

গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস অনুসারে, শাহ ফয়সাল মসজিদের মোট আয়তন ৪৬.৮৭ একর, যার মধ্যে মসজিদের ভেতরের হলের আয়তন ১.১৯ একর। এই হলটিতে এক লক্ষ মুসল্লি একসাথে নামাজ আদায় করতে পারেন এবং হলের বাইরের উঠোন এবং মাঠে আরও দুই লক্ষ মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন।

বর্তমানে বাদশাহ ফয়সাল মসজিদ বিশ্বের বৃহত্তম মসজিদের অবস্থান হারিয়েছে। গিনেস বুক অফ রেকর্ডস অনুসারে, বর্তমানে বাদশা ফয়সাল মসজিদ বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম এবং পাকিস্তানের দ্বিতীয় বৃহত্তম মসজিদ। করাচির বাহরিয়া টাউনে পাকিস্তানের বৃহত্তম মসজিদ নির্মিত হয়েছে।