নিরাপত্তার অভাবে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের বিয়ে দিচ্ছেন অভিভাবকরা

রামপালের কৈগরদাসকাঠি চর

প্রকাশিত: ১২:০৯ অপরাহ্ণ, মে ১৩, ২০২৫

বাগেরহাট প্রতিনিধি:

 

বাগেরহাটের রামপাল উপজেলার পশুর নদীর তীরবর্তী কৈগরদাসকাঠি চরের মানুষের জীবন যেন এক গভীর সংকটের আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। এক সময়ের সমৃদ্ধ জনপদ আজ উন্নয়ন প্রকল্পের কারণে বাস্তুহারা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাব, কর্মসংস্থানের সুযোগের অভাব আর নিরাপত্তাহীনতার কারণে এই চরের অভিভাবকেরা বাধ্য হয়ে তাদের অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের বাল্যবিবাহ দিচ্ছেন। এই ভয়াবহ চিত্র যেন কৈগরদাসকাঠির মানুষের দৈনন্দিন জীবনের এক নির্মম বাস্তবতা।

এক যুগ আগেও কৈগরদাসকাঠি ছিল সবুজ আর সমৃদ্ধির প্রতিচ্ছবি। মাঠ ভরা ধান আর নদীতে মাছ ছিল এখানকার মানুষের জীবনধারণের মূল ভিত্তি। কিন্তু ২০১০ সালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য জমি অধিগ্রহণ শুরু হলে তাদের জীবনে নেমে আসে এক কালো মেঘ। ১৮৩৪ একর জমি অধিগ্রহণ করে সেখানে ১৩২০ মেগাওয়াটের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়। এই প্রকল্পের জন্য ভিটেমাটি হারাতে হয় বহু পরিবারকে। সরকার ১৪২টি আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ করে বাস্তুহারাদের ঠাঁই দিলেও একটি ছোট ঘরে ৬-৭ জন সদস্যের বসবাস যেন তাদের দুঃখ আরও বাড়িয়ে দেয়।

এই আশ্রয়কেন্দ্রে বসবাসকারী মুরশিদা বেগমের জীবন তেমনই এক করুণ দৃষ্টান্ত। অভাবের তাড়নায় স্বামী আমিনুর শেখ খুলনায় রিকশা চালান এবং মুরশিদা নদীতে মাছ ধরে সংসার চালান। চার চারটি মেয়ে সন্তান যেন তার কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ আরও গভীর করে তোলে। গেল বছর অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া বড় মেয়ে আছিয়াকে বাধ্য হয়ে বিয়ে দিয়েছেন চুনপরী গ্রামের এক ছেলের সাথে।

মোরশেদা বেগম আক্ষেপ করে বলেন, আগে আমরা ভালো ছিলাম, জমিতে ফসল হতো, নদীতে মাছ পাওয়া যেত। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র হওয়ার পর নদীর মাছও নেই। সরকার যে ঘর দিয়েছে, ভালোভাবে থাকতে পারি না। আর চারটা মেয়ে, তাদের নিরাপত্তা কে দেবে? নিরাপত্তার জন্যই বড় মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিয়েছি।

একই আশ্রয়কেন্দ্রে বসবাসকারী, বাল্যবিবাহের শিকার এক নারী (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) জানান তার করুণ অভিজ্ঞতা। তিনি বলেন, আমি তখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি। আমার বয়স ছিল মাত্র ১৩ বছর। আমি স্কুলে যেতে চেয়েছিলাম। হঠাৎ একদিন আব্বু বলল, আজ তোমার আর স্কুলে যেতে হবে না। তোমাকে দেখতে আসবে। আমি নিরুপায় হয়ে কিছু বলতে পারিনি। তারপর আমার বিয়ে দিলো পাশের গ্রামের একটা ছেলের সাথে। খুব বেশি দিন সংসার করতে পারিনি। আমাকে বউ হিসেবে নিয়ে গেলেও তারা কাজের মেয়ের মতো ব্যবহার করতো। আমি নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে চলে আসি। কান্নারত কণ্ঠে তিনি আরও বলেন, আমি শুধু একটা কথাই বলতে চাই, আমার মতো এত অল্প বয়সে যেন আর কারও বিয়ে না হয়।

মরিয়ম (ছদ্মনাম) যার সহপাঠীদের সাথে মাঠেঘাটে হেসে খেলার কথা, সেই বয়সেই তাকে চাপ নিতে হচ্ছে সংসারের। লাল টুকটুকে শাড়ি পরে পুতুল খেলার বয়সেই শ্বশুরবাড়ির বধূ সেজে যেতে হচ্ছে তাকে।

তানিয়া আক্তার, যিনি নিজেও এই আশ্রয়কেন্দ্রে থাকেন, বাল্যবিবাহের ভয়াবহতা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, বাল্যবিবাহ নিয়ে যদি বলতে চান, তাহলে এখানে প্রতিটি ঘরে ঘরে এমন ডিভোর্সি মেয়ে খুঁজে পাওয়া যাবে, যারা বাল্যবিবাহের শিকার। এখানে বাল্যবিবাহের অন্যতম প্রধান কারণ হলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অভাব। লেখাপড়া করার জন্য পশুর নদী পার হয়ে ওপারে যেতে হয়। এর পাশাপাশি নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ না থাকায় অন্য স্থান থেকে এখানে বাল্যবিবাহ বেশি হয়। এখানে যারা বিয়ে করতে আসে, তাদের অধিকাংশই বউ হিসেবে নিয়ে গিয়ে বাড়ির কাজের মেয়ের মতো ব্যবহার করে। আমরা আশ্রয়কেন্দ্রে থাকি, আমাদের কোনো উপায় নেই।

কালাম নামের স্থানীয় এক বাসিন্দা জানান, আগে ‘ইনিশিয়েট ফর রাইট ভিউ’ নামে একটি এনজিও কাজ করত, যারা সাধারণ মানুষকে সচেতন করত। তিনি মনে করেন, অন্য কোনো বেসরকারি সংস্থা এগিয়ে এলে এবং সরকারের উন্নয়নমূলক কার্যক্রম বাস্তবায়িত হলে এই মারাত্মক ব্যাধি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।

কৈগরদাসকাঠি সরকারি সাইক্লোন কাম প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা রোকসনা বেগম জানান, স্কুলের শিক্ষকরা নিয়মিত মা সমাবেশ ও অভিভাবক সমাবেশে বাল্যবিবাহের কুফল সম্পর্কে সচেতন করেন। তবে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাগুলোও যদি সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করে তাহলে এখানকার মানুষ আরও সতর্ক হবে।

দীর্ঘদিন ধরে বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে কাজ করা ও উন্নয়ন কর্মী সুব্রত কুমার ব্যানার্জি বলেন, বাল্যবিবাহ শুধু একটি সামাজিক ব্যাধি নয়, এটি এক ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন। কৈগরদাসকাঠির মতো এলাকা যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাস্তুচ্যুতি ঘটেছে, সেখানে বাল্যবিবাহের ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়। কারণ পরিবারগুলো নিরাপত্তাহীনতা, আয় রোজগারের সংকট ও ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি পেতে অল্প বয়সেই মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেয়।

তিনি আরও বলেন, সরকারি পুনর্বাসন প্রকল্পের সঙ্গে যদি মনোসামাজিক সহায়তা, নিরাপত্তা ও শিক্ষা-সুবিধা নিশ্চিত করা না হয়, তাহলে এই পরিবারগুলো নিজেদের ভবিষ্যৎ গড়ার সুযোগ হারায়। শুধু ঘর দিলেই হয় না প্রয়োজন প্রশিক্ষণ, কাজের সুযোগ, এবং মেয়েদের জন্য নিরাপদ শিক্ষার পরিবেশ।

বাগেরহাট সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক অসীম কুমার সমদ্দার ঢাকা পোস্টকে বলেন, অল্প বয়সে সন্তান ধারণ করলে কিশোরীদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমাদের হাসপাতালে প্রায়ই এমন কিশোরী মায়েদের দেখতে পাই যারা অপুষ্টি, রক্তস্বল্পতা বা প্রসবজনিত জটিলতা নিয়ে ভর্তি হয়।

তিনি আরও বলেন, শিশুকালেই মেয়েদের ওপর পরিবার গঠনের চাপ দিলে তারা না পারে নিজের শরীর গুছিয়ে নিতে, না পারে মানসিকভাবে তৈরি হতে। বাল্যবিবাহের কারণে অনেক মেয়েই অবসাদ, পারিবারিক সহিংসতা ও জন্মগত শিশুমৃত্যুর মতো চরম ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। এই সমস্যা বন্ধ করতে হলে শুধু সচেতনতা নয়, স্বাস্থ্যসেবাকেও সহজপ্রাপ্য করতে হবে চরাঞ্চলের মেয়েদের জন্য।

স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, গত এক বছরে কৈগরদাসকাঠি গ্রামে ১৩টি বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটেছে। চলতি তিন মাসে আরও চারটি বাল্যবিবাহ হয়েছে।

কৈগরদাসকাঠির এই ভয়াবহ চিত্র একদিকে যেমন উন্নয়নের নির্মম পরিণতি, তেমনি অন্যদিকে শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের অভাব এবং নিরাপত্তাহীনতার এক করুণ প্রতিচ্ছবি। এই জনপদের মানুষের স্বাভাবিক জীবন ফিরিয়ে আনতে এবং বাল্যবিবাহের অভিশাপ থেকে মুক্তি দিতে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। সরকার এবং বেসরকারি সংস্থাগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টাই পারে এই অসহায় মানুষগুলোর জীবনে নতুন আলো আনতে।