স্ত্রী ও সন্তান পুড়ে গেছে, আমি বের হয়ে বেঁচে থেকে লাভ কী

প্রকাশিত: ১২:৪৬ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ৬, ২০২৪

সাইফুল ইসলাম:

রাজধানীর গোপীবাগে বেনাপোল এক্সপ্রেসে আগুনে জানালায় দুই হাত বাইরে থাকা অবস্থায় এক ব্যক্তির পুড়ে যাওয়ার দৃশ্য ছুঁয়ে গেছে মানুষকে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছবিটি ভাইরাল হয়েছে। সেই ব্যক্তিকে উদ্ধারের চেষ্টা করেছিলেন স্থানীয়রা। কিন্তু তার (পুড়ে যাওয়া ব্যক্তি) স্ত্রী ও সন্তান পুড়ে যাওয়ার পর ‘বের হয়ে কী হবে?’ বলেছিলেন বলে জানান গোপীবাগ এলাকার বাসিন্দা মাসুদ রানা।

শুক্রবার রাতে যশোরের বেনাপোল থেকে ঢাকায় আসা বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনটি তার গন্তব্যস্থল কমলাপুর পৌঁছার কিলোমিটার দুয়েক আগে থেমে যেতে বাধ্য হয়। দুর্বৃত্তদের আগুনে ট্রেনটির ২টি বগি পুরোপুরি ও অপর ২টি বগির অধিকাংশই পুড়ে যায়। বগি চারটি থেকে চারজনের মরদেহ উদ্ধার করার কথা জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস।

বেনাপোল থেকে যাত্রীবোঝাই করে ঢাকায় ফিরছিল ট্রেনটি। কিছু বুঝে ওঠার আগেই হঠাৎ গোপীবাগে আগুন দেখতে পান যাত্রীরা। চলন্ত অবস্থায় হুড়োহুড়ি করে নামতে থাকেন যাত্রীরা। আগুন লাগার সংবাদ পেয়ে ট্রেনচালক ট্রেনটি থামিয়ে দেন। এ সময় বেশিরভাগ যাত্রী নামতে পারলেও কিছু যাত্রী আগুনের ভয়াবহতায় নামতে পারেননি। তারা আগুনে নিঃশেষ হয়ে যান। এখন পর্যন্ত চারজন যাত্রীর মরদেহ উদ্ধারের খবর জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স।

বাচ্চাডাকে জানালা দিয়ে ফেলেছিলাম, নিচে এক লোক ক্যাচ ধরেছেঃ

মেহেরপুরের দর্শনা স্টেশন থেকে ট্রেনে সপরিবারে ঢাকায় ফিরছিলেন আশরাফুল। আগামী ৯ জানুয়ারি দুবাইয়ের ফ্লাইট ছিল তার। তবে এই যাত্রা আর হচ্ছে না। সবকিছু পুড়ে গেলেও পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নিরাপদে বের হতে পেরেছেন তিনি।

আশরাফুল নিউজ পোস্টকে বলেন, পরিবারসহ বেনাপোল এক্সপ্রেসের ‘ছ’ বগিতে ছিলাম। হঠাৎ আগুন আগুন বলে চিৎকার এরপর ধোঁয়ায় কিচ্ছু দেখা যাচ্ছিল না। আমার ছোট বাচ্চাডাকে জানালা দিয়ে কোনোরকম ফেলে দিয়েছিলাম। নিচে এক লোক ক্যাচ ধরে ফেলায় বেঁচে গেছে বাচ্চা।

তিনি বলেন, পরে আমার স্ত্রী ও আরেক ছেলে অনেক কষ্ট করে বের হয়েছে। আমি জানালা দিয়ে ঝাঁপ দিয়েছিলাম। আগুনে আমাদের কোনো ক্ষতি হয়নি।

আশরাফুল আরও বলেন, আগুনে আমার পাসপোর্ট, টিকিট, নগদ ৫০ হাজার টাকা এবং লাগেজ ট্রেনের ভেতরেই ছিল। পুড়ে গেছে। কিছুই বাঁচাতে পারিনি। বিদেশযাত্রা বাতিল হলেও পরিবারকে রক্ষা করতে পেরেছি।

ফিরছিলেন কলকাতা থেকে, লাগেজ রেখেই ট্রেন থেকে লাফঃ

লালমাটিয়া গার্লস স্কুল অ্যান্ড কলেজের সহকারী অধ্যাপক এস এম জয় জানান, তিনি স্ত্রীকে নিয়ে কলকাতা থেকে আসছিলেন। তারাও ‘ছ’ বগিতে ছিলেন। ট্রেনটি সায়েদাবাদ ছাড়ার কিছুক্ষণ পর হঠাৎ থেমে যায়। তারা ভেবেছিলাম স্টেশনে পৌঁছেছেন। কিন্তু হঠাৎ আগুন দেখে ভয় পেয়ে যান। সমস্ত লাগেজ রেখে ট্রেন থেকে লাফ দেন তারা।

দুই মেয়েসহ ট্রেন থেকে ঝাঁপ দেন তানিয়াঃ

কুষ্টিয়ার পোড়াদহ থেকে ঢাকায় আসছিলেন তানিয়া। হঠাৎ ট্রেনটিতে আগুন লেগে গেলে দুই মেয়েকে নিয়ে ট্রেন থেকে ঝাঁপ দেন তিনি। ঘটনাস্থলে যখন তার সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তখনো ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব ছিলেন তিনি।

তানিয়া বলেন, সবাই বলছিল যে, এটা গ্যাস থেকে শুরু হয়েছে। হৈচৈ হচ্ছিল। কেউ চেইন টেনে ট্রেন থামিয়ে দিলো। আমি দুই মেয়েসহ ট্রেন থেকে ঝাঁপ দিলাম।

ছেলে দগ্ধ, ছেলের স্ত্রী নিখোঁজঃ

আমার ছেলে আসিফ তার স্ত্রী নাতাশাকে নিয়ে ফরিদপুরের ভাঙ্গা এলাকায় আত্মীয়র বাসায় বেড়াতে গিয়েছিল। সেখান থেকে ফেরার পথে ঘটনার শিকার হয়। আগুন লাগার পর দরজা দিয়ে বের হতে না পেরে আসিফ জানালা দিয়ে মাথা বের করে। সে সময়ে লোকজন তাকে টেনে বের করতে পারলেও তার স্ত্রী নাতাশা বের হতে পারেনি। ধারণা করা হচ্ছে, নাতাশা ট্রেনেই রয়ে গেছে। আমরা এখনো নাতাশাকে খুঁজে পাইনি।

হতাশাভরা কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা আবু সিদ্দিক খান। শোকগ্রস্ত এই বাবা জানান, গোপীবাগে বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে অগ্নিকাণ্ডে তার ছেলে আসিফ খান (৩০) দগ্ধ হয়েছেন। নিখোঁজ পুত্রবধূর নাম নাতাশা জেসমিন। তাদের গ্রামের বাড়ি নেত্রকোনায় এবং বর্তমানে রাজধানীর গেন্ডারিয়ার বাসিন্দা।

শুক্রবার রাত ১০টার দিকে দগ্ধ অবস্থায় আসিফকে উদ্ধার করে শেখ হাসিনার জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে নিয়ে আসা হয়। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন ডা. তরিকুল ইসলাম।

তিনি বলেন, ট্রেনে দগ্ধ একজন আমাদের জরুরি বিভাগে এসেছেন। তার শরীরের আট শতাংশ দগ্ধ হয়েছে। জরুরি বিভাগে তার চিকিৎসা চলছে।

ঢামেক মর্গে চার মরদেহ, শনাক্ত করতে পারছেন না স্বজনরা, ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ শুরুঃ

বেনাপোল এক্সপ্রেসে আগুনের ঘটনায় নিহত চারজনের মরদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে। চার মরদেহের মধ্যে একজন নারী ও একজন শিশু। বাকি দুজনের মরদেহ এতটাই বিকৃত হয়ে গেছে যে শনাক্ত করা যায়নি। স্বজনরা তাদের পরিজন দাবি করলেও মরদেহ দেখে শনাক্ত করতে পারছেন না। আজ শনিবার সকাল থেকেই স্বজনরা ভিড় করেন ঢামেক মর্গে। সবাই মরদেহ শনাক্তের চেষ্টা করেন। চিনতে না পারায় তাদের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ শুরু করেছে কর্তৃপক্ষ।

ঢাকা রেলওয়ে থানার (কমলাপুর) উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. সেতাফুর রহমান নিউজ পোস্টকে বলেন, চারটি মরদেহের মধ্যে দুজন নারী ও শিশু। বাকি দুজন নারী না পুরুষ বোঝা যাচ্ছে না। নাতাশা জেসমিন (২৫) ও এলিনা ইয়াসমিন (৩০) নামে দুই নারীর মরদেহ দাবি করে তাদের স্বজনরা এসেছেন। তারা মরদেহ দেখেও শনাক্ত করতে পারেননি। ডিএনএ টেস্ট করে শনাক্ত করা হবে।

আগুন লাগা বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনের যাত্রীদের বরাত দিয়ে র‍্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেছেন, প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে এটি নাশকতা। ট্রেনের যাত্রীরা জানিয়েছেন, ট্রেনটিতে অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা তারা দেখেছেন। শুক্রবার (৫ জানুয়ারি) দিনগত রাতে রাজধানীর জুরাইন রেলগেট সংলগ্ন বস্তির একটি বাড়ি থেকে বিপুল পরিমাণ ককটেল, পেট্রোলবোমা ও বিস্ফোরক তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধারের পর সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন।

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, বেনাপোল এক্সপ্রেসে আগুন লাগার কারণ, কোথা থেকে আগুনের সূত্রপাত এবং কোন জায়গা থেকে আগুন দেওয়া হয়েছে- এসব বিষয়ে এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে রাবের গোয়েন্দা দল। যারা ট্রেনটিতে যাত্রী ছিলেন অগ্নিসংযোগের মতো ঘটনা তারা দেখেছেন।

বেনাপোল এক্সপ্রেসের আগুন পরিকল্পিতঃ

বেনাপোল এক্সপ্রেসে আগুন নাশকতা এবং পরিকল্পিত বলে মন্তব্য করেছেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার ড. খ. মহিদ উদ্দিন। তিনি বলেন, এটি যে নাশকতা সেটি স্পষ্ট। এটা বোঝাই যায় যে ইচ্ছা করে পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে। যারা করেছে আমরা মনে করি তাদের আইনের কাছে যেতে হবে। তিনটি কম্পার্টমেন্ট কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কারণ এই মুহূর্তে বলা যাবে না, কী কারণে হয়েছে। তবে এটি যে নাশকতা সেটি স্পষ্ট। এটা বোঝাই যায় যে ইচ্ছা করে পরিকল্পিতভাবে করা হয়েছে। এ ধরনের অমানবিক ঘটনা সাধারণ যাত্রীর প্রতি, সাধারণ মানুষের প্রতি, শিশুর প্রতি, নারীর প্রতি এ ধরনের সহিংসতা ও আগুনে পুড়িয়ে মারা- এটি কোনো মানুষ গ্রহণ করতে পারে না। আমরা মনে করি তাদের খুঁজে বের করা হবে এবং তাদের আইনের আওতায় নেওয়া হবে।

নাশকতা কি না খতিয়ে দেখার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীরঃ

বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে অগ্নিকাণ্ডে হতাহতদের প্রতি সমবেদনা জানিয়ে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শুক্রবার রাতে প্রধানমন্ত্রীর সহকারী প্রেস সচিব এ বি এম সরওয়ার-ই-আলম সরকার এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নাশকতা কি না- তা খতিয়ে দেখতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন। তিনি নিহতদের আত্মার মাগফিরাত করেছেন এবং আহতদের চিকিৎসার জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দিয়েছেন।

রেলের ৭ সদস্যের তদন্ত কমিটিঃ

বেনাপোল থেকে ঢাকাগামী বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুনের ঘটনায় সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। শুক্রবার রাত ১২টার রেল মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা সিরাজ-উদ-দৌলা খান নিউজ পোস্টকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ রেলওয়ের ঢাকা বিভাগীয় সংকেত ও টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলী মো. সৌমিক শাওন কবিরকে প্রধান করে সাত সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটি তিন কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করবেন।

৬ ও ৭ জানুয়ারি চলবে না বেনাপোল এক্সপ্রেসসহ ২২ ট্রেনঃ

গোপীবাগে ঢাকা-মাওয়া রেলপথে পুড়ে যাওয়া বেনাপোল এক্সপ্রেসসহ বিভিন্ন রুটের ২২টি ট্রেন দুদিন না চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এই দুদিন হচ্ছে- নির্বাচনের আগের দিন ৬ জানুয়ারি এবং নির্বাচনের দিন ৭ জানুয়ারি। রাত পৌনে ১টার দিকে বাংলাদেশ রেলওয়ে পশ্চিম মহাব্যবস্থাপকের ফেসবুক পোস্টে এই তথ্য জানানো হয়।

ওই পোস্টে বলা হয়, সম্মানিত যাত্রী সাধারণের সদয় অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, অনিবার্য কারণবশত আগামী ৬-৭ জানুয়ারি বেনাপোল এক্সপ্রেস ও ঢালারচর এক্সপ্রেস ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকবে। এছাড়া মহানন্দা (আপ/ডাউন), রকেট (আপ/ডাউন), পদ্মরাগ (২১/২২), রংপুর শাটল (৯৭/৯৮), ঢাকা কমিউটার (৯৯), রাজশাহী কমিউটার (৫/৬) এবং বগুড়া কমিউটার (৫/৬) ট্রেন চলাচল আগামী ৬ ও ৭ জানুয়ারি পুরোপুরি বন্ধ থাকবে।