রাজধানীতে দুই সন্তানকে গলাকেটে হত্যার পর আত্মহত্যার চেষ্টা করেন মা

প্রকাশিত: ১১:৩১ অপরাহ্ণ, মার্চ ৭, ২০২০

‘দুই মেয়েকে নিয়ে শুক্রবার সকালে আমার বাসায় আসার কথা ছিল পপির। কিন্তু তারা আসেনি। না আসার কারণ জানতে পপিকে বারবার কল করছিলাম, ধরছিল না। অস্থির হয়ে আমি ছুটে যাই পপির বাসায়। দরজায় অনেকবার ধাক্কা দিলেও খুলছিল না। কিছুক্ষণ পর গায়ে কম্বল জড়ানো অবস্থায় দরজা খুলে পপি। আমাকে দেখেই চিৎকার দিয়ে বলে, বাবা আমার দুই মেয়েকে আমি হত্যা করেছি, নিজের গায়ে আমি নিজেই আগুন দিয়েছি’—কান্নাজড়িত কণ্ঠে কথাগুলো বলছিলেন খিলগাঁওয়ে নিহত দুই শিশুর নানা আবু তালেব।

 

শনিবার (৭ মার্চ) সকাল সাড়ে ৮টার দিকে খিলগাঁওয়ের গোড়ান এলাকার ৩৯৭ নম্বর বাসা থেকে মেহজাবিন আলভী (১১) ও জান্নাতুল ফেরদৌস জান্নাত (৬) নামে দুই শিশুর গলাকাটা মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। ওই দুই শিশুর মাক আক্তারোন্নেছা পপিকে (৩৫) দগ্ধ অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। জানা গেছে, দুই শিশু সন্তানকে হত্যার পর আত্মহত্যা করতে নিজের শরীরে আগুন দেন পপি (৩৫)। এতে তার শরীরের ১৮ শতাংশ পুড়ে গেছে। পপি বর্তমানে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে পুলিশ প্রহরায় চিকিৎসাধীন। ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুলের চতুর্থ শ্রেণিতে পড়তো আলভি, প্রথম শ্রেণিতে পড়তো জান্নাত। দুই শিশুর বাবা মোজাম্মেল হক বিপ্লবের মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগরে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম বিক্রির দোকান রয়েছে।

 

নিহত দুই শিশুর নানা ও দগ্ধ পপি’র বাবা আবু তালেব বলেন, ‘শনিবার সকালে পপির বাসার দরজায় ধাক্কানোর সময় পাশের ফ্ল্যাট থেকে এক মহিলা এসে জানায়, রাতে পপি তার দুই মেয়েকে নাকি অনেক মারধর করেছে, তারা চিৎকার শুনেছেন। এর কিছুক্ষণ পর গায়ে কম্বল জড়ানো অবস্থায় দরজা খুলে পপি। আমাকে দেখে চিৎকার দিয়ে বলে—বাবা আমার দুই মেয়েকে আমি হত্যা করেছি, নিজের গায়ে আমি নিজেই আগুন দিয়েছি।’ তিনি বলেন, ‘আমার মেয়ে (পপি) এমন কাজ কেন করলো? আমার নিষ্পাপ দুইটা নাতনিকে কেন হত্যা করলো?’

 

ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে বার্ন ইউনিটে চিকিৎসাধীন পপি। দুই সন্তানকে কেন হত্যা করেছেন—জানতে চাইলে নিশ্চুপ হয়ে যান তিনি। চোখ দুটো জলে টলমল করছিল তার। হাসপাতালের নার্সদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরে পপি জানান, ‘মেয়ে দুটো ন্যাশনাল আইডিয়াল স্কুলে পড়ে। শ্রীনগরে ভাইয়ের সঙ্গে ইলেকট্রনিক্সের ব্যবসা করে তার স্বামী। কিন্তু ব্যবসার আয়-ব্যয়ের কোনও হিসাব সে (স্বামী) রাখে না। সন্তান নিয়ে ঢাকায় থাকি। সে ঠিকমতো সংসার খরচ দিতে চায় না। মেয়েদের স্কুলের খরচ আছে। এসব বিষয়ে কোনও মাথা ব্যথা নেই বিপ্লবের। টাকার কথা বললেই বকাবকি করতো বিপ্লব। দুই সপ্তাহ আগে চল্লিশ দিনের চিল্লায় যায় সে। এসময় সংসারের কোনও খরচ দেয়নি। যোগাযোগ করেনি। বলতে গেলেই সে আমাকে তালাক দেবে, আরেকটা বিয়ে করবে বলে হুমকি দিতো। গত মাসের ২৮ তারিখে সর্বশেষে সে বাবায় এসেছিল। এরপর আর আসেনি। গতকাল (শুক্রবার) আসার কথা থাকলেও আসেনি।’

 

পুলিশ বলছে, স্বামী-স্ত্রীর সাংসারিক কলহের জেরে দুই শিশু সন্তানকে গলা কেটে হত্যা করে আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিলেন পপি। ঘটনাস্থল থেকে রক্ত মাখা বটি উদ্ধার করা হয়েছে। একটি চিরকুটও পাওয়া গেছে। চিরকুটে পারিবারিক নানা কলহের কথা লেখা রয়েছে। তবে এটি সুইসাইড নোট নয়।

খিলগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মশিউর রহমান বলেন, ‘পরিবারের সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা গেছে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে নানা বিষয় নিয়ে ঝগড়া-বিবাদ হতো। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার হওয়ার আলামত ও পারিপার্শ্বিক অবস্থা দেখে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা যাচ্ছে দুই শিশুকে গলা কেটে হত্যার পর মা আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। তবে বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘এই ঘটনার কারণ জানতে আমরা দুই শিশুর বাবাকে থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদ করছি। সেই সঙ্গে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের জিজ্ঞাসাবাদ করে দেখা হচ্ছে।’

 

খিলগাঁওয়ের দক্ষিণ গোড়ান এলাকার মোল্লা টাওয়ারের ৪র্থ তলায় ৪-ডি ফ্ল্যাটে দুই সন্তান নিয়ে গত ২ বছর ধরে থাকেন পপি। ওই বাড়িতে গিয়ে অন্যান্য ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পপি খুব রির্জাভ থাকতেন। কারও সঙ্গে মিশতেন না, কথাও বলতেন না।

 

পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা রুবিনা আলম বলেন, ‘তিনি (পপি) কারও সঙ্গে মিশতেন না। আর তার মেয়ে দুটোকে অন্যদের সঙ্গে খেলতে দিতেন না। তবে তাদের পারিবারিক কী ঝামেলা ছিল সেটি আমরা জানি না।’ অপর ফ্ল্যাটের বাসিন্দা পারুল আক্তার বলেন, ‘প্রায় তিনি (পপি) বাচ্চাদের মারধর করতেন। আমরা শুনতাম। তবে বাচ্চা দুটো অনেক ভদ্র ছিল। ওর মা যখন মারতে যেতো, তখন বলতো আম্মু সরি আর করবো, মেরো না। এমন বলতে আমরা শুনেছি। গত রাতে মারধরের শব্দ শুনে আমি তার (পপি) বাসার দরজায় ধাক্কা দিলে সে সামান্য খুলে বলে কিছু হয়নি, আপনারা ঘুমান। এরপর সকালে উঠেই শুনতে পাই যে শিশু দুটিকে গলা কেটে হত্যা করেছে।’