যুদ্ধের অবসান এবং ফিলিস্তিন সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান চায় শিক্ষার্থীরা

প্রকাশিত: ৩:১৯ অপরাহ্ণ, মে ১৩, ২০২৪

আন্তর্জাতিক ডেস্ক রিপোর্টঃ 

শুরুটা হয়েছিল নিউ ইয়র্কের কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি থেকে। ছড়িয়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ বাইরের বিভিন্ন দেশের শিক্ষাঙ্গনে। ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানিয়ে অবস্থান কর্মসূচি এবং ইসরায়েলের পক্ষেও সমাবেশ হয়েছে বা হচ্ছে। কর্তৃপক্ষের আশঙ্কা এ থেকে ইহুদিবিরোধী প্রচারণা ছড়িয়ে পড়তে পারে। বাকস্বাধীনতা ও অ্যান্টি সেমিটিজম নিয়ে এমন দ্বন্দ্বে যুক্তরাষ্ট্রকে সম্ভবত আগে কখনো পড়তে হয়নি। বিক্ষোভ এখনো চলছে। অনেকে মনে করেন পাঠ্যসূচি থেকেই শিক্ষার্থীরা ঔপনিবেশিকতা-বিরোধী হয়ে উঠেছে। এ কারণে তারা মাঠে নেমেছেন। তবে বিজ্ঞজনরা বলছেন ভিন্ন কথা।

কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীরা ১৭ এপ্রিল ম্যানহাটান ক্যাম্পাসে গাজা সংহতি ক্যাম্প করে। ইউনিভার্সিটির প্রেসিডেন্ট (ভিসি) মিনোচ শফিক এদিন কংগ্রেসের শুনানিতে অংশ নেন। রিপাবলিকান দলের সদস্যরা তার বিরুদ্ধে ক্যাম্পাসে গাজা সংহতির নামে অ্যান্টি সেমিটিজম (ইহুদি বিদ্বেষ) ছড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ করেন। ছাত্র বিক্ষোভ ক্রমেই বেড়েছে , এক পর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষও হয়। ২২ এপ্রিল এই ইস্যুতে ইয়েল ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভের সময় পুলিশ শত শত শিক্ষার্থীকে আটক করে। এ পর্যন্ত দেশটিতে আটকের সংখ্যা আড়াই হাজার ছাড়িয়ে গেছে।

প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার মাইক জনসন ২৫ এপ্রিল বলেন, কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটিতেও। যুক্তরাষ্ট্রের ৪৫টি অঙ্গরাজ্যের ১৪০টি কলেজ ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ ছড়িয়ে গেছে বলে গার্ডিয়ান ৮ মে খবর দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে বিক্ষোভের উত্তাপ পৌঁছে যায় বহির্বিশ্বেও। উল্লেখ্য, ৭ অক্টোবর লড়াই শুরুর পর পশ্চিমা অনেক দেশে ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানিয়ে বিক্ষোভ নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।

শিক্ষার্থীরা কি সিলেবাস থেকে অতিমাত্রায় উপনিবেশ বিরোধী হওয়ার দীক্ষা নিয়েছে? এবারের বিক্ষোভের এপিসেন্টার বা উত্পত্তিস্থল কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির গ্র্যাজুয়েট স্কুল অব জার্নালিজমের প্রফেসর হাওয়ার্ড ডব্লিউ ফ্রেঞ্চ অবশ্য তা মনে করেন না। তার লেখা সর্বশেষ বই—‘বর্ন ইন ব্ল্যাকনেস :আফ্রিকা, আফ্রািকানস অ্যান্ড দি মেকিং মডার্ন ওয়ার্ল্ড, ১৪৭১ টু দি সেকেন্ড ওয়ার্ল্ড ওয়ার’। বইটি লিখতে চার বছর সময় লেগেছে তার। বর্তমান পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন শুরুর প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছেন।

১৮ এপ্রিল ১৯৫৫ সাল। ইন্দোনেশিয়ার তত্কালীন প্রেসিডেন্ট সুকর্নো এক অভূতপূর্ব আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বলেন, ‘আমাদের বর্তমান সময়টি খুবই বৈচিত্র্যপূর্ণ। শান্তির সঙ্গে এশিয়া ও আফ্রিকার সব রাজনৈতিক ও আদর্শিক শক্তিতে আমরা ঐক্যবদ্ধ করতে পারি।’ সম্মেললনটি অভূতপূর্ব ছিল এ কারণে যে এটি কোনো প্রথাগত আন্তর্জাতিক সম্মেলন ছিল না। এশিয়া ও আফ্রিকার ২৯টি দেশের প্রতিনিধিরা এতে অংশ নিয়েছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল দুটো—বিশ্বযুদ্ধ ও ঔপনেবিশেকতা উত্তর বিশ্বে দরিদ্র ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর পরিচয় তৈরি। তক্ষণকার দ্বিমেরু বিশ্বব্যবস্থার বাইরে নিজস্ব অবস্থান তৈরি করা খুব কঠিন একটি কাজ ছিল। এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলো দেখতে পেল বিশ্ব থেকে ঔপনিবেশিকাত দূর হয়েছে ঠিকই কিন্তু বিশ্ব দুই পরাশক্তির বলয়ে আটকা পড়েছে। সুকর্নো চেয়েছিলেন এই দুইটি ধারার বাইরে তৃতীয় একটি নিরপেক্ষ ধারা তৈরি করতে, যে কোনো দেশ স্বেচ্ছায় তাতে যোগ দিতে পারবে। যুক্তরাষ্ট্র ঐ সম্মেলনে কোনো প্রতিনিধি পাঠায়নি বা সম্মেলন উপলক্ষ্যে কোনো বাণীও দেয়নি। এই ঘটনা ইতিহাসে বানদুং সম্মেলন নামে পরিচিত। তত্কালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন ফস্টার ডুলেস সম্মেলনের আগে এক সাক্ষাত্কারে বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই সম্মেলনকে স্বীকৃতি দেওয়ার বা এর গুরুত্ব বাড়িয়ে তোলার কোনো ইচ্ছাই নেই। জোট নিরপক্ষ আন্দোলনের যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৯৬১ সালে তবে বানদুং সম্মেলন মূলত এর সূত্রপাত ঘটিয়েছিল। এর মূল কথা ছিল এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার সদ্য স্বাধীন দেশগুলোর নিজস্ব অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা। পাশাপাশি দেশগুলো ছোট হোক বা বড় প্রতিটি দেশের এবং প্রত্যেক জাতিগোষ্ঠীর পরিচয় অক্ষুণ্ন রাখা এবং যে কোনো আন্তর্জাতিক বিবাদ শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধান করা।

ফ্রেঞ্চ বলছেন, আফ্রিকার ওপর বইটি লেখার সময় গত চার বছর ধরে তার চিন্তুার জগৎ প্রভাবিত করে রেখেছিল বানদুং সম্মেলন। কিন্তু অতি সম্প্রতি শুরু হওয়া ছাত্র আন্দোলন বা ক্যাম্পাস বিক্ষোভ তার কাছে বানদুং সম্মেলনের নতুন তাত্পর্য তুলে ধরেছে। সেটি হলো যুক্তরাষ্ট্রের মতো সুপারপাওয়ার বাইরের দুনিয়া বিশেষ করে নিজ বলয়ের বাইরে যেসব দেশ বা জাতিগোষ্ঠী যারা স্বাধীন জাতিসত্তা নিয়ে টিকে থাকতে চায় তাদের কী দৃষ্টিতে দেখে। কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থীদের দাবি—যুদ্ধ বন্ধ হোক এবং ফিলিস্তিন সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান হোক। তারা হামাসেরও পক্ষ নেয়নি বা ইহুদি বিদ্বেষ ছড়ানোর জন্য মাঠে নামেননি। ফ্রেঞ্চ মনে করেন, ঔপনিবেশিক যুগের অবসান হলেও বৃহত্ শক্তিগুলো ঔপনিবেশিক মানসিকতা থেকে এখনো বেরিয়ে আসেনি। যেমন পুরোনো উপনিবেশ আফ্রিকার ওপর নিয়ন্ত্রণ হাতছাড়া হোক সেটা সাবেক ঔপনিবেশিক ইউরোপ এখনো চায় না।