মোহাম্মদপুরে গৃহকর্মীর মৃত্যুর ঘটনায় জনমনে নানান গুঞ্জন

প্রকাশিত: ১১:২৪ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২৪

# কারাগারে গৃহকর্তা দম্পতি
# হত্যার অভিযোগে বিচারের দাবিতে মানববন্ধন
# মৃত্যুর রহস্য উদঘাটনে তদন্ত করছে পুলিশ

সাইফুল ইসলাম:
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের শাজাহান রোডের একটি বাসার নিচতলার গ্যারেজের ওপর থেকে প্রীতি উড়ান (১৫) নামে এক শিশু গৃহকর্মীর রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় জনমনে নানান গুঞ্জন শুরু হয়েছে। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় সাংবাদিক আশফাক দম্পতিকে আদালতের নির্দেশে কারাগারে প্রেরণ করা হয়েছে। মানবাধিকারকর্মী ও আইন বিশ্লেষকরা বলছেন, মামলা যে ধারায় হয়েছে সেটি সঠিক না। এবং অনেকগুলো প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে।
জানা গেছে, গত ৬ ফেব্রæয়ারি সকালে মোহাম্মদপুরের শাহজাহান রোডের একটি ভবনের নিচতলা থেকে শিশু গৃহকর্মী প্রীতি উড়ানকে (১৫) রক্তাক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে যান বাসার কেয়ারটেকার। হাসপাতালে নেওয়ার আগেই তার মৃত্যু হয় বলে জানিয়েছেন কর্তব্যরত চিকিৎসক। ওই ভবনের অষ্টম তলার একটি ফ্ল্যাটে ডেইলি স্টারের নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আশফাকুল হক দম্পতির বাসা। ঘটনার পরে বাসার সবাইকে আটক করা হলেও ১২ঘন্টারও পরে এজাহার প্রস্তুত করে আশফাক দম্পতিকে গ্রেফতার করা হয়। গত ৭ ফেব্রæয়ারি পুলিশ তাদের আদালতে হাজির করে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ডের আবেদন করেন। বিজ্ঞ আদালত রিমান্ড নামঞ্জুর করে তাদের কারাগারে পাঠিয়ে দেন। ঘটনার সময় থেকে এখন পর্যন্ত এই মৃত্যুকে ঘিরে জনমনে নানান প্রশ্ন ঘুরপাক খেলেও এখনো তার জবাব মেলেনি।
স্থানীয়রা জানায়, এ ঘটনার ছয় মাস আগেও ফেরদৌসি নামের সাত বছরের এক শিশু গৃহকর্মী ওই বাসা থেকে লাফ দিয়েছিল। রক্তাক্ত জখম হলেও সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে যায় সেই শিশুটি। সে ঘটনায় মামলাও হয়েছিল। সেই ঘটনার ছয় মাস না পেরোতেই আবারও এক শিশু গৃহকর্মী একই বাসা থেকে লাফ দেয়। এবার আর ভাগ্য সহায় হয়নি। আট তলা থেকে এক তলার গ্যারেজের ছাদের ওপর পড়ে ১৫ বছর বয়সী শিশু গৃহকর্মী প্রীতি উড়ান। হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। প্রশ্ন উঠেছে- ছয় মাস আগে যে বারান্দা থেকে একজন পড়ে গেলো, সেই বারান্দায় গ্রীল লাগানোর প্রয়োজন সাংবাদিক আশফাক দম্পতি বোধ করেছিলেন কিনা?। আগের ঘটনার পরে আবারও পুনরাবৃত্তি হয় যদি একই ঘটনার এবং কারোর মৃত্যুর কারণ হয় তারপরেও কীভাবে সেটা কেবল অবহেলা হয়ে থাকে কী?।
নিহত প্রীতি উড়ানের বাবা অভিযোগ করে বলেন, অভাবের কারণে দুই বছর আগে মিন্টু নামে স্থানীয় এক ব্যক্তির মাধ্যমে সাংবাদিক আশফাকুল হক দম্পতির বাসায় আমার ছোট মেয়ে প্রীতি উড়ানকে গৃহকর্মীর কাজে পাঠিয়েছিলাম। কিন্তু আশফাকুল হকের পরিবার দুই বছরেও মেয়েকে আমাদের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করতে দেয়নি। মাসে দুই-একবার গৃহকর্তার মোবাইলে যোগাযোগ করে কথা বলিয়ে দিতো তারা। প্রশ্ন উঠছে, একজন সচেতন সাংবাদিক তার বাসায় শিশুকে গৃহকর্মে নিয়োগ দিতে পারেন কিনা?।
২০২২ সালে ‘আইএলও কনভেনশন-১৩৮’ অনুসমর্থনের প্রস্তাবে নীতিগত অনুমোদন দেওয়া হয়। বৈঠক শেষে সচিবালয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম ওই সনদে শিশুশ্রমের ন্যূনতম বয়স সংক্রান্ত শর্তগুলো তুলে ধরেন সাংবাদিকদের কাছে। তিনি বলেন, এখানে তিনটা জিনিস আছে। একটা হল জেনারেল ভিউটা, যেহেতু বেসিক এডুকেশন করতে ১৫ বছর লাগে সুতরাং ১৫ বছরের কম কোনো বাচ্চাকে কাজে লাগানো যাবে না। দুই নম্বরে আরেকটু রিল্যাক্স করেছে, তবে কোনো দেশের যদি আর্থ সামাজিক অবস্থা বিশেষ বিবেচনার পরিপ্রেক্ষিতে তারা কমাতে চায় তাহলে ১৪ বছর পর্যন্ত কমানো যাবে, এর উপর না। তিন নম্বরে বলেছে, এই যে ১৪ হোক বা ১৫ই হোক এই শিশুদের কোনো অবস্থাতেই কোনো ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োগ করা যাবে না। সনদের গুরুত্ব সম্পর্কে তিনি বলেন, যেসব কাজে তাদের এক্সিডেন্ট হওয়ার বা জীবন নাশের সম্ভাবনা আছে সেই সব কাজে কোনোভাবেই এসব শিশুদেরকে ব্যবহার করা যাবে না।
এদিকে শিশু গ্রহকর্মী প্রীতিকে হত্যা করা হয়েছে দাবি করে এর বিচার চেয়েছে পরিবার ও এলাকাবাসী। এ দাবিতে গত শনিবার সকালে মিরতিংগা চা-বাগানের শ্রমিক ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের ব্যানারে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়। মানববন্ধন কর্মসূচিতে বক্তব্য দেন রহিমপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ইফতেখার আহমেদ বদরুল, মিরতিংগা চা-বাগান পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি মন্টু অলমিক প্রমুখ। মানববন্ধনে বক্তারা ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে বিচারের দাবি জানান। মানববন্ধনে চা-বাগানের শ্রমিকসহ স্থানীয় লোকজন ও জনপ্রতিনিধিরা অংশ নেন।
এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্পর্শকাতর এ ঘটনার তদন্ত সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা বলেন, বারবার একই ধরনের দুর্ঘটনা ঘটার কথা নয়। ওই বাসায় কেউ না কেউ গৃহকর্মীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার বা শারীরিক-মানসিক নির্যাতন করতেন বলে তারা ধারণা করছেন। এ কারণে গৃহকর্মীরা বাসায় স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন না। বাসা থেকে পালাতে গিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হয়েছে। এছাড়া কেউ ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে কি না তাও গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
মোহাম্মদপুর থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মাহফুজুল হক ভুঁইয়া নিউজ পোস্টকে বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সৈয়দ আশফাকুল হক ও তার স্ত্রী তানিয়া খন্দকার গৃহকর্মীর নিচে পড়া সম্পর্কে কিছু জানেন না বলে দাবি করেছেন। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে প্রকৃত কারণ উদ্ঘাটনের চেষ্টা চলছে।