রোহিঙ্গা নারীনেত্রী ইয়াসমিন উল্লাহর কথায় মানুষ হিসেবে এবং অন্যদের সমমর্যাদার স্বীকৃতির আনন্দ এনে দিয়েছে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) আদেশ। বস্তুত এই আদেশ বা রায়ের প্রাপ্তি এখানে। আদালত রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা লাভের অধিকারী একটি জাতিগোষ্ঠীর স্বীকৃতি দিয়েছেন, যা শুনানির সময়েও মিয়ানমারের নেত্রী সু চি অস্বীকার করেছেন। তিনি বিদ্রোহী গোষ্ঠী আরসার নামোচ্চারণ ছাড়া আর কোথাও রোহিঙ্গা পরিচয় ব্যবহার করেননি। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে করা গাম্বিয়ার মামলায় গত বৃহস্পতিবার আইসিজের বিচারপতিরা পুরো আদেশে রোহিঙ্গাদের সুরক্ষা দিতে বলেছেন।
রোহিঙ্গাদের গণহত্যা থেকে বাঁচাতে আদালতের দ্বারস্থ হয়ে গাম্বিয়ার আইনমন্ত্রী আবুবকর মারি তামবাদু বলেছিলেন, মানবিকতার আবেদনে সাড়া দিতে বিশ্ব ব্যর্থ হয়েছে বলেই তাঁর দেশ এগিয়ে এসেছে। সরাসরি তাঁর ওপর কোনো প্রভাব না পড়লেও গণহত্যা সনদ বাস্তবায়নে যে দূরবর্তী এবং ছোট একটি দেশও মানবিক দায়িত্ব পালন করতে পারে, এটি হচ্ছে এই আদেশের দ্বিতীয় অর্জন।
মিয়ানমার আইসিজের আদেশে যে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে, তাতে এটা স্পষ্ট যে, অন্তর্বর্তী ব্যবস্থাগুলো বাস্তবায়ন সুদূরপরাহত। কিন্তু বিবৃতিতে মিয়ানমার সরাসরি এটি প্রত্যাখ্যানের কথা বলেনি। দাবি করেছে, তাদের গঠিত তদন্তে গণহত্যার প্রমাণ মেলেনি। আইসিজের আদেশকে কিছুটা বিকৃত ব্যাখ্যার চেষ্টা করেছে এই বলে যে, আদালতের আদেশে গণহত্যার অভিযোগের সত্যাসত্য বিচার করা হয়নি। অভিযোগের সত্যাসত্য (মেরিট) বিচার করা হয়নি ঠিকই, কিন্তু আদালত বলেছেন, রোহিঙ্গাবিরোধী অভিযানে গণহত্যার উদ্দেশ্য থেকে থাকতে পারে—এমনটি বিশ্বাস করার কারণ রয়েছে। আদালত এ ক্ষেত্রে জাতিসংঘ তথ্যানুসন্ধানী দলের রিপোর্টকে যেমন বিবেচনা করেছেন, তেমনই মিয়ানমারের মানবাধিকার আইন লঙ্ঘনের স্বীকারোক্তির কথা বলেছেন। এই রায়ে তাই তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হচ্ছে মিয়ানমারের এই স্বীকৃতিকে আদালত গণহত্যার মতো অপরাধের শ্রেণিতে স্থান দিয়েছেন।
ছোট একটি দেশও যে মানবিক দায়িত্ব পালন করতে পারে, এটি এই আদেশের একটি অর্জন।
চতুর্থত, আদালতে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারজয়ী অং সান সু চির অংশগ্রহণে আইসিজের এখতিয়ার মেনে নেওয়ায় মিয়ানমারের সম্মতির সর্বোচ্চ প্রতিফলন ঘটেছে। এখন তাই মামলা থেকে সরে যাওয়া বা রায় অমান্য করা সহজ হবে না।
পঞ্চমত, আইসিজের আদেশের তিন দিন আগে মিয়ানমার তাদের গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টের সূত্র ধরে গণহত্যা হয়নি বলে যে দাবি করেছিল, সেই রিপোর্টও তারা প্রকাশ করেনি। ধারণা করা যায়, সেটিতেও নৃশংসতার যেসব বিবরণ আছে, তা প্রকাশ পেলে গণহত্যা ঘটেনি—এমন ব্যাখ্যা নাকচ হয়ে যাবে। এখন সেটি প্রকাশের চাপ বাড়বে।
ষষ্ঠত, বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য মিয়ানমার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরিতে ব্যর্থ হয়েছে বলে আইসিজে যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন, তা দেশটির ওপর নতুন করে চাপ তৈরি করবে। বাংলাদেশের জন্য কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টির একটি নতুন সুযোগ এনে দিয়েছে এই আদেশ।
সপ্তমত, এই রায় বাস্তবায়নে আদালত প্রথমে চার মাস এবং পরে বছরে দুবার প্রতিবেদন দেওয়ার যে নির্দেশ দিয়েছেন, তাতে মিয়ানমারের ওপর নজর রাখা বা তদারকির দায়িত্ব এখন আইসিজে, তথা নিরাপত্তা পরিষদের। আদালত তাঁর কাজের রীতি অনুযায়ী জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে এই নির্দেশনার কপি পাঠিয়ে দেবেন। বাংলাদেশ, ওআইসিসহ সমমনোভাবাপন্ন সব দেশ ও মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলোর এখন উচিত হবে নিরাপত্তা পরিষদের প্রতি তাদের প্রত্যাশিত দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানানো।
এই আদেশ বাস্তবায়নে অস্বীকৃতি মিয়ানমারকে আবারও সেই সামরিক শাসনামলের মতো একঘরে করে ফেলতে পারে। শুধু চীন কিংবা ভারতের সমর্থন বিশ্বজনমতের বিরূপ প্রভাব ও তার ক্ষতি কাটাতে যথেষ্ট হবে না।
বৈশ্বিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার বিদ্যমান কাঠামো ও ব্যবস্থার প্রতি আস্থা পুনরুদ্ধারের এটি একটি সুযোগ। সেটিকে কাজে লাগাতে হবে। রোহিঙ্গা নেতা তুন খিনের কথায়, দীর্ঘ চার যুগের বেশি সময় ধরে তাঁরা বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত জাতিগোষ্ঠী হিসেবে যে দুর্ভোগের শিকার হয়ে এসেছেন, এই রায় এবার তাঁদের বিচারপ্রাপ্তির আশাকে জাগ্রত করেছে। সেই বিবেচনায় এটি অবশ্যই একটি সুসংবাদ।