মমতার মন্তব্যে কেন ক্ষুব্ধ পশ্চিমবঙ্গের সাধু-সন্তদের একাংশ

প্রকাশিত: ৬:৪৪ অপরাহ্ণ, মে ২২, ২০২৪

আন্তর্জাতিক ডেস্ক রিপোর্টঃ 

লোকসভা নির্বাচনের প্রচারে গিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের প্রধান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দুটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন সন্ন্যাসীর রাজনীতির সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে যে মন্তব্য করেছিলেন, তাতে পশ্চিমবঙ্গের সাধু-সন্তরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন।সনাতন সংসদ নামে সাধু-সন্তদের একটি সঙ্ঘের সহসভাপতি সর্বানন্দ মহারাজ বলেন, ‘সেবামূলক কাজ করতে সংসার ছেড়ে এসে যে মুখ্যমন্ত্রীর মুখে এমন অপমানিত হতে হবে, তা কল্পনাও করি নি।’

মঙ্গলবার সাধু-সন্তদের একটি প্রভাবশালী সংগঠন ঘোষণা করেছে যে মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে ২৪ মে কয়েকশ সন্ন্যাসী খালি পায় কলকাতার রাস্তায় নামবেন তারা।ভোটের প্রচারে গিয়ে দিন তিনেক আগে মমতা বলেছিলেন, রামকৃষ্ণ মিশন এবং ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের কয়েকজন সন্ন্যাসী বিজেপিকে সহায়তা করার জন্য তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে কাজ করছেন।

তৃণমূল নেত্রীর এই মন্তব্যের পরেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি থেকে শুরু করে পুরো বিজেপি নেতৃত্বই তাকে পাল্টা আক্রমণ করতে শুরু করেছেন। মমতার ওই একটা মন্তব্য ভোটের প্রচারে বিজেপির হাতে নতুন করে মেরুকরণের অস্ত্র তুলে দিয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

কী বলেছিলেন মমতা- গত শনিবার এক নির্বাচনী সভায় মমতা বলেছিলেন, ‘বহরমপুরে (মুর্শিদাবাদের জেলা সদর) একজন মহারাজ আছেন। তার ব্যাপারে অনেক দিন ধরে শুনছি। কার্তিক মহারাজ বলেন যে তিনি বুথে তৃণমূলের এজেন্ট বসতে দেবেন না। আমি তাকে সন্ন্যাসী বলে গণ্যই করি না কারণ তিনি সরাসরি রাজনীতি করছেন এবং দেশের সর্বনাশ করছেন। ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের প্রতি আমার খুব শ্রদ্ধা আছে। আমি যে সব প্রতিষ্ঠানকে শ্রদ্ধা করি, সেই তালিকায় এই সঙ্ঘ দীর্ঘদিন ধরেই রয়েছে।’

তিনি রামকৃষ্ণ মিশনের প্রসঙ্গও তোলেন সেদিন। তিনি বলেছিলেন, ‘কেন সন্ন্যাসীরা এর মধ্যে ঢুকছেন? রামকৃষ্ণ মিশনকে সবাই শ্রদ্ধা করে। আমি জানি রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসীরা ভোট দেন না। কিন্তু আপনারা কেন অন্যদের বলছেন বিজেপিকে ভোট দেওয়ার কথা? সবাই নয়, কিন্তু কয়েকজন (সন্ন্যাসী) এটা করছেন।’

স্বামী বিবেকানন্দ রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আর ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের প্রতিষ্ঠা করেন স্বামী প্রণবানন্দ।দুটি প্রতিষ্ঠানই সারা বিশ্বে ছড়িয়ে আছে। এরা ধর্মীয় সংগঠন হলেও সেবামূলক কাজ, শিক্ষার প্রসার আর বিপর্যয়ের সময়ে ত্রাণ সহায়তার কাজে অগ্রণী ভূমিকা রাখে।

হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির গবেষক স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য অবশ্য বলছেন, রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সঙ্গে প্রতিষ্ঠান হিসাবে রাজনীতির কোনও যোগ না থাকলেও ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের অধীন ‘হিন্দু মিলন মন্দিরগুলোকে নিয়মিতই বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মতো আরএসএসের সংগঠনগুলি কাজে লাগিয়ে থাকে।

কী বলছে রামকৃষ্ণ মিশন আর ভারত সেবাশ্রম- রামকৃষ্ণ মিশন আর ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস নেত্রী যা বলেছেন, তা নিয়ে দুটি প্রতিষ্ঠান দুইরকম প্রতিক্রিয়া দিয়েছে।

রামকৃষ্ণ মিশনের প্রধান কেন্দ্র বেলুড় মঠের সিনিয়র সন্ন্যাসী সংবাদ সংস্থা পিটিআইকে জানিয়েছেন, ‘যে ইঙ্গিত করা হয়েছে, তাতে আমরা বেদনাহত। আমরা কোনো বিতর্কে জড়াতে চাই না। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির হাজার হাজার মানুষ আমাদের প্রতিষ্ঠানে প্রার্থনা আর ধ্যান করতে আসেন, এদের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী আর মুখ্যমন্ত্রীও রয়েছেন। সবাই আমাদের কাছে সমান।’

অন্যদিকে ভারত সেবাশ্রমের যে সন্ন্যাসীর নাম উল্লেখ করে রাজনীতির সঙ্গে সর্ম্পকের অভিযোগ করেছিলেন মমতা ব্যানার্জী, সেই কার্তিক মহারাজ আইনি নোটিশ পাঠিয়েছেন। তবে সেটা সঙ্ঘের তরফে নয়, ব্যক্তিগত ভাবে পাঠানো নোটিশ।

তিনি মঙ্গলবার বলেছেন, ‘ওই মন্তব্যের প্রতিবাদ তো দেশ জুড়েই হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকেও আমাকে মেসেজ পাঠানো হয়েছে। আমরা আলাদা করে কী আর বলব, কী প্রতিবাদ করব। ওদিকে মুখ্যমন্ত্রীও তো তার বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাই বিষয়টিকে আমরা আর টেনে নিয়ে যেতে চাইছি না। ক্ষমা-সুন্দর দৃষ্টিতেই দেখতে চাই। তবে ব্যক্তিগত ভাবে যদি কেউ আইনি নোটিশ পাঠিয়ে থাকেন, সেটা তার ব্যাপার, সঙ্ঘ এতে জড়িত নয়।’

মন্তব্য নিয়ে যে ব্যাখ্যা দিলেন মমতা- প্রথমদিন কামারপুকুরের জনসভা থেকে করা মন্তব্যের পরে অবশ্য মমতা ব্যানার্জী ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে তিনি ওই দুটি ধর্মীয়-সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কিছু বলেননি, মাত্র কয়েকজন সন্ন্যাসীর রাজনীতি-যোগ নিয়ে কথা বলেছেন।

তার কথায়, ‘আমি রামকৃষ্ণ মিশনের বিরুদ্ধে নই, আমি কেন একটা ইন্সটিটিউশনের বিরুদ্ধে হব? আর আমি অসম্মানই বা কেন করব? আমি তো কয়েকদিন আগেও মহারাজ অসুস্থ ছিলেন, তাকে দেখতে গেছিলাম। আমি বলেছি দু-একজনের কথা। গঙ্গাসাগরে ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘের অফিস আছে, আশ্রম আছে, ওরা এত ভাল, ওরা সত্যি আমাকে খুব ভালবাসে এবং মানুষের কাজ করে। আমি একটি লোকের নাম করে বলেছিলাম, তার নাম কার্তিক মহারাজ। তিনি আমাদের এজেন্ট বসতে দেয়নি তৃণমূল কংগ্রেসের। ভোটের দু-দিন আগে মুর্শিদাবাদে যে দাঙ্গাটা করিয়েছিলেন, তার হোতা ছিলেন উনি, আমি সেই জন্য বলেছিলাম।’

কিন্তু মমতার প্রথম মন্তব্যের পরেই প্রধানমন্ত্রীসহ পুরো বিজেপি পরিবার প্রচারে নেমে পড়ে এই বলে যে তৃণমূল নেত্রী সাধু-সন্ন্যাসীদের অসম্মান করেছেন। তার প্রথম দিনের মন্তব্যের পরেই বিষয়টি নিয়ে মাঠে নামতে দেরি করেনি বিজেপি।

পশ্চিমবঙ্গে ভোটের প্রচারে এসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, ‘তৃণমূল কংগ্রেস সব সীমা অতিক্রম করে গেছে। ইস্কন, রামকৃষ্ণ মিশন আর ভারত সেবাশ্রম সঙ্ঘ তাদের সেবা এবং নৈতিকতার জন্যই পরিচিত, কিন্তু বাংলার মুখ্যমন্ত্রী তাদের সরাসরি হুমকি দিচ্ছেন। তাদের ভোট ব্যাংককে তুষ্ট করার জন্যই এটা করছে।’