
ডেস্ক রিপোর্ট:
ভারত-পাকিস্তান সম্প্রতি পালটাপালটি ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলার পর যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। তবে এই সংঘাতকে কাজে লাগিয়ে দেশ দুটির অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সুবিধা নিতে চেষ্টা করতে পারে কয়েকটি মহল।
কিছু দিন আগ পর্যন্তও দেশের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের জন্য সমালোচনার মুখোমুখি হতে হয়েছে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে। পাকিস্তানের অনেক নাগরিক মনে করেন, দেশটির সবশেষ নির্বাচনে সেনাবাহিনীর জেনারেলরা তাদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরানকে ক্ষমতায় আসতে দেননি। বিশেষভাবে তারা সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনিরকে দোষারোপ করছিলেন।
করাচির একজন ট্যাক্সিচালক কয়েক মাস আগে জার্মান সংবাদমাধ্যম ডয়চেভেলেকে বলেন, সেনাবাহিনীর কারণে আমাদের অনেক সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে। কিন্তু গত ২২ এপ্রিল ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পহেলগামে এক হামলায় ২৬ জন নিহত হওয়ায় সব কিছুই বদলে গেছে। এই হামলার দায় স্বীকার করেছে কাশ্মীরভিত্তিক সংগঠন কাশ্মীর রেজিস্ট্যান্স।
ভারত সরকার দাবি করেছে, কাশ্মীর রেজিস্ট্যান্স ‘দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট’ নামে পরিচিত এবং জাতিসংঘের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী সংগঠন লস্কর-ই-তাইয়্যেবার সঙ্গে সম্পৃক্ত।
পহেলগাম হামলার জন্য দিল্লি দায়ী করেছে ইসলামাবাদকে, যদিও পাকিস্তান এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে। এই হামলার পরিপ্রেক্ষিতেই দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের সামরিক বাহিনী সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে।
গত ৭ মে ভারতের বিমান বাহিনী পাকিস্তান ও পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের বেশ কিছু জায়গায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। এতে বেশ কিছু বেসামরিক নাগরিক প্রাণ হারান। দিল্লি দাবি করেছে, তারা জঙ্গিদের আস্তানায় হামলা চালিয়েছে। দুই দিন পর পাকিস্তানের পালটা হামলায় অন্তত কিছু ভারতীয় নাগরিকও মারা যান।
ভারতের দাবি, তাদের অপারেশন সিন্দুর বা সিঁদুরের ফলে ৩৫ থেকে ৪০ জন পাকিস্তানি সেনা মারা গেছেন। পাকিস্তানের বেশ কয়েকটি অত্যাধুনিক যুদ্ধবিমান ধ্বংস হয়েছে। পাকিস্তানের অনেকগুলো সামরিক ঘাঁটিতে আক্রমণ করা হয়েছে। ভারতের নৌবাহিনী করাচিতে আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল।
ভারতীয় সেনা কর্মকর্তাদের মতে, ভারতের লক্ষ্য ছিল জঙ্গিদের ঘাঁটি লক্ষ্য করে আক্রমণ চালানো। পাকিস্তানের বাহাওয়ালপুর, মুরিদকে, মুজাফফরাবাদের জঙ্গি খাঁটিতে আক্রমণ করে সেগুলোকে বিধ্বস্ত করা হয়েছে। পাকিস্তান ৮ ও ৯ মে ভারতের সামরিক ঘাঁটি লক্ষ্য করে হামলা করার চেষ্টা করে। ভারতের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম সেগুলোর মোকাবিলা করে এবং তা ব্যর্থ করে দেয়।
অন্যদিকে পাকিস্তানের দাবি, ভারত পাকিস্তানের আকাশসীমা লংঘন করার পর তারা অপারেশন বুনিয়ানউম মারসুস শুরু করে। ভারতের ২৬টি সামরিক টার্গেট লক্ষ্য করে হামলা করা হয়। প্রতিটি জায়গায় প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। পাকিস্তানের সেনাকর্তাদের দাবি, তাদের নৌবাহিনী মুম্বাইয়ের কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল।
এরপর গত ১০ মে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক বার্তায় জানান, ভারত ও পাকিস্তান সম্পূর্ণ এবং তাৎক্ষণিক যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়েছে। এরপর দুই দেশের কর্মকর্তারাও একই কথা জানান। যুদ্ধবিরতির পর দুই দেশের বিভিন্ন মহল থেকেই জয়ের দাবি করা হয়েছে। আর দুই দেশের বিভিন্ন পক্ষ থেকে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টাও করছে।
ইসলামাবাদভিত্তিক রাজনৈতিক বিশ্লেষক নাজির মাহমুদ। বলেন, জনপ্রিয় নয় এমন সরকার এ ধরনের সেনা সংঘাত থেকে লাভবান হবে। ভারতের হামলার পর সাধারণত যারা উদার ও ধর্ম নিরপেক্ষ এবং সেনাবাহিনীর সমালোচক ছিলেন, তারাও চাচ্ছিলেন ইসলামাবাদের উচিত দিল্লিকে একটি শিক্ষা দেওয়া। নাজির মাহমুদ বলেন, ইতিমধ্যে সরকারের সবকিছু সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ করলেও এই ঘটনার পর রাজনীতিতে তাদের নিয়ন্ত্রণ আরো শক্তিশালী হবে।
ভারতের জাতীয়তাবাদী আদর্শের অনুসারীরা অবশ্য এই সংঘাতকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তার হিন্দু-জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি)-র বিজয় হিসেবেই দেখছেন। পহেলগামে হামলায় জড়িত ও তাদের মদতদাতাদের শায়েস্তা করতে মোদি সরকারের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হয়েছিল।
ভারতের নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উদয় ভাস্কর ডয়চে ভেলেকে বলেন, মোদিকে এটি প্রমাণ করতে হতো যে, পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ঢুকে পাঞ্জাব, মুরিদকে ও ভাওয়াল্গুরে হামলা চালানোয় তিনি ভারতকে নেতৃত্ব দিতে সক্ষম।
তিনি আরো বলেন, এই বয়ানের মাধ্যমে মোদির নেতৃত্বাধীন ভারত অনেক শক্তিশালী ও সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের ধারণা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পাশপাশি হিন্দুত্ববাদের রক্ষাকর্তা হিসেবেও ভোটের রাজনীতিতে তারা লাভবান হবে। বিহার প্রদেশের আসন্ন নির্বাচনে এটির প্রভাব দেখা যেতে পারে।
তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, দুই দেশের সংঘাতে ভুক্তভোগী হতে হবে দেশ দুটির সাধারণ নাগরিকদের। এই সংঘাতের অর্থনৈতিক প্রভাব পড়বে পাকিস্তানে। অন্যদিকে ভারত সরকার তাদের রাজনৈতিক বিরোধী শক্তি ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সমালোচনাকে পাশ কাটাতে ব্যবহার করতে পারে এই সংঘাত।