ভারতের পার্লামেন্টে মোদির ভাষণে কেন আচমকা যশোর-বরিশালের দুই নেতার উল্লেখ?

প্রকাশিত: ২:১৯ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ৭, ২০২০

ভারতের লোকসভায় বৃহস্পতিবার (৬ ফেব্রুয়ারি) রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর বিতর্কের জবাব দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দুই জন প্রয়াত বাঙালি নেতাকে স্মরণ করেছেন। তাদের নিয়ে অনেক কথাও বলেছেন। এই দুই বাঙালি হলেন— যশোরের সন্তান ও স্বাধীনতা সংগ্রামী ভূপেন্দ্র কুমার দত্ত, আর অন্যজন বরিশালে জন্ম নেওয়া যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল– যিনি দেশভাগের পর পাকিস্তান সরকারের প্রথম আইনমন্ত্রী ছিলেন।
কিন্তু তাদের দুজনেরই মৃত্যুর বহু বছর পর ভারতের পার্লামেন্টে কেন আচমকা তাদের প্রসঙ্গ তুললেন প্রধানমন্ত্রী মোদি?

আসলে ভূপেন দত্ত আর যোগেন মণ্ডল, দুজনেই ছিলেন সেই বিরল হিন্দু রাজনীতিবিদদের অন্যতম, যারা সাত চল্লিশের দেশভাগের সময় পূর্ব পাকিস্তানে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

পাকিস্তানের গঠন পর্বে সংবিধান প্রণয়ন বা মন্ত্রিসভাতেও তাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কিন্তু সে সময় পাকিস্তান যেভাবে হিন্দু জনসংখ্যাকে দেশ থেকে বিতাড়নের নীতি নিয়ে চলছিল, এরা দুজনেই তার প্রতিবাদ করে নিজ নিজ পদ থেকে ইস্তফা দেন।

ভূপেন্দ্র কুমার দত্ত পাকিস্তানের সংবিধান সভা থেকে, আর যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল সে দেশের প্রথম মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী মোদি জানিয়েছেন, ‘পরে তাদের দুজনকেই পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে চলে আসতে হয়, আর তাদের মৃত্যুও হয় এই মহান ভারতের কোলেই।’

পাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে আসা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নাগরিকত্ব দেওয়ার বিধান এনে তার সরকার নতুন যে আইন এনেছে, স্বভাবতই তার স্বপক্ষে সওয়াল করতে গিয়েই প্রধানমন্ত্রী মোদি এই দুই নেতার প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন। পর্যবেক্ষকরা আরও মনে করছেন, ‘ভূপেন দত্ত বা যোগেন মণ্ডলের রেফারেন্স দিয়ে মোদি এটাও বোঝাতে চেয়েছেন যে, বাংলাদেশে তথাকথিত যে হিন্দু নির্যাতনের কথা ভারত বলছে— তার ভিত আসলে পূর্ব পাকিস্তান আমলেরই, স্বাধীন বাংলাদেশে তা অতটা প্রাসঙ্গিক নয়।’

কিন্তু সদ্যগঠিত পূর্ব পাকিস্তানে ঠিক কী ভূমিকা ছিল এই দুই হিন্দু নেতার?

ভূপেন্দ্র কুমার দত্তের জন্ম ১৮৯২ সালে, যশোর জেলার ঠাকুরপুর গ্রামে। ব্রিটিশ আমলে সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েন তিনি। বিপ্লবী সংগঠন অনুশীলন সমিতির সক্রিয় সদস্যও ছিলেন ভূপেন্দ্র। জীবনের প্রায় ২৩ বছর জেলে কাটিয়েছেন তিনি, একবার জেলে টানা ৭৮ দিন অনশনও করেছিলেন। মোদি জানিয়েছেন, পরে ভূপেন্দ্র কুমার দত্ত ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যও হন।

দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানেই থেকে যান তিনি, যোগ দেন সে দেশের সংবিধান রচনার কাজেও। কিন্তু সেখানে যেভাবে হিন্দুদের ওপর অত্যাচার শুরু হয়, তাতে ভূপেন দত্তর মোহভঙ্গ হয় অচিরেই। সংবিধান সভার সদস্য পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে তিনি লেখেন, ‘পাকিস্তানের এই প্রান্তে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা যেভাবে নিপীড়িত হচ্ছেন, তাতে তারা নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। এখানে হিন্দুরা প্রবল হতাশার মধ্যে কালাতিপাত করছেন।’

এরপর ১৯৬২ সালে পাকাপাকিভাবে রাজনীতি ত্যাগ করে ভূপেন দত্ত ভারতে চলে আসেন। ভারতের মাটিতেই তিনি মারা যান, ১৯৭৯ সালে।

যোগেন্দ্র নাথ মণ্ডল জন্মেছিলেন ১৯০৪ সালে, বরিশালের এক সামাজিকভাবে পশ্চাৎপদ পরিবারে। নিম্নবর্ণের হিন্দু বা নমঃশূদ্র সমাজের প্রতিনিধি হয়েও তিনি হিন্দুদের জাতপাতের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে গেছেন। দেশভাগের পর তিনি পাকিস্তানের প্রথম আইন ও শ্রমমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। দেশের কেবিনেট মন্ত্রী হিসেবে ১৯৪৭ সালে তিনি করাচিতেও যান, যা তখন ছিল গোটা পাকিস্তানেরই রাজধানী শহর।

কিন্তু মাত্র তিন বছরের মধ্যেই হতাশ ও বীতশ্রদ্ধ হয়ে তিনি মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৫০ সালের ৯ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে লেখা পদত্যাগ পত্রে তিনি লেখেন, ‘আমাকে বলতেই হবে, হিন্দুদের বিতাড়িত করার যে নীতি নিয়ে এ দেশ চলছে, তা পশ্চিম পাকিস্তানে ইতোমধ্যেই সম্পূর্ণ সফল হয়েছে, আর পূর্ব পাকিস্তানেও তা পূর্ণ সফল হওয়ার পথে।’

‘আমি এ কথাও বলতে বাধ্য হচ্ছি, মুসলিম লীগ পাকিস্তান পেয়েও সন্তুষ্ট হয়নি। তারা এদেশের হিন্দু ইন্টেলেজেনশিয়া বা বুদ্ধিজীবী সমাজকেও সম্পূর্ণ নির্মূল করতে চায়, যাতে পাকিস্তানের জীবন-সমাজ-সংস্কৃতিতে তাদের কোনও প্রভাবই না থাকে।’

প্রধানমন্ত্রী মোদি এদিন যোগেন মণ্ডলের সেই চিঠি থেকে ওপরের অংশ পুরোটাই উদ্ধৃত করেছেন। জানিয়েছেন, এরপর যোগেন মণ্ডলও সে বছরই পাকিস্তানের পাট গুটিয়ে ভারতে চলে আসেন। ১৯৬৮ সালে কলকাতার কাছে বনগাঁতে তিনি মারা যান।

কিন্তু এত বছর বাদে ভারতের পার্লামেন্টে ভূপেন দত্ত ও যোগেন মণ্ডলের উল্লেখ কী তাৎপর্য বহন করছে?

দিল্লির জেএনইউ-তে দক্ষিণ এশিয়া স্টাডিজের চেয়ারম্যান সঞ্জয় ভরদ্বাজের মতে, ‘এদের দুজনের জীবনের ঘটনা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী এটাই বোঝাতে চেয়েছেন যে, দেশভাগের পর পাকিস্তান সে দেশে থেকে যাওয়া হিন্দুদের সঙ্গে বিরাট একটা অন্যায় করেছিল। তার (মোদি) সরকার নাগরিকত্ব আইন এনে এতদিন বাদে সেই ভুলটা শোধরানোর চেষ্টা করছে।’

‘আরও একটা জিনিস খেয়াল করবেন, পার্লামেন্টে এদিন দুটো সভা মিলে প্রধানমন্ত্রী প্রায় ঘণ্টাতিনেক বলেছেন– কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে কোনও সংখ্যালঘু নির্যাতনের কথা কিন্তু একবারও বলেননি। এর মাধ্যমে ঢাকায় ক্ষমতাসীন শেখ হাসিনা সরকারকে তিনি কী বার্তা দিতে চেয়েছেন, সেটাও কিন্তু বোঝা শক্ত নয়!’