ব্যবসার সূত্র ধরে হিমেলকে অপহরণ, চাওয়া হয় ২ কোটি টাকা মুক্তিপণ

প্রকাশিত: ৪:১৫ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ২৫, ২০২৪

হাবিবা ইসলাম 

চার মাস আগে হাসিবুর রহমান হিমেলের বাবা মারা যান। তিনি ব্যাটারি বিক্রির ব্যবসা করতেন। হিমেল রাজধানীর উত্তরার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। বাবা মারা যাওয়ার পর পড়াশোনার পাশাপাশি ব্যবসা পরিচালনা করতেন। গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর সকালে ব্যবসায়িক কাজে শেরপুর যাওয়ার জন্য ড্রাইভার ছামিদুলকে নিয়ে ব্যক্তিগত প্রাইভেটকারে রওনা দেন। পরে গাজীপুরে সালনা এলাকায় পৌঁছালে অপহরণের শিকার হন। হিমেলকে অপহরণ করে দুই কোটি টাকা মুক্তিপণ দাবি করে একটি চক্র। মুক্তিপণ আদায়ে হিমেলের ওপর চালানো হতো পাশবিক নির্যাতন। পরে বুধবার (২৪ জানুয়ারি) রাতে সুনামগঞ্জের তাহিরপুরের সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে হিমেলেকে উদ্ধার করে র‌্যাব। এ সময় চক্রের মূলহোতাসহ পাঁচ জনকে গ্রেফতার করা হয়।

বৃহস্পতিবার (২৫ জানুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর কাওরান বাজার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংস্থাটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এ সব তথ্য জানান।গ্রেফতার ব্যক্তিরা হলো– মো. আব্দুল মালেক (৩৫), ছামিদুল ইসলাম (৩০), রনি নাবাল (৪১), মো. রাসেল মিয়া (৩৪) ও মো. বিল্লাল হোসেন। তাদের কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, দুই রাউন্ড গুলি এবং দুইটি ওয়াকিটকি সেট উদ্ধার করা হয়েছে।

খন্দকার আল মঈন বলেন, চক্রের মূল হোতা মো. আব্দুল মালেক। সে পেশায় গাড়ি চালক। গাড়ি চালানোর আড়ালে সে গ্রেফতার ব্যক্তিদের নিয়ে গড়ে তুলেছিল সংঘবদ্ধ অপহরণ চক্র। ধনাঢ্য পরিবারের সদস্যদের অপরহণ করতো চক্রটি। মুক্তিপণ হিসেবে আদায় করতো মোটা অংকের টাকা। মুক্তিপণ দিতে অস্বীকৃতি জানালে নির্যাতন চালাতো। সেই দৃশ্য ভিডিও করে পাঠাতো ভুক্তভোগীদের আত্মীয়-স্বজনের কাছে।

তিনি বলেন, গত বছরের ২৬ ডিসেম্বর সকাল আনুমানিক সাড়ে ৯টা রাজধানীর উত্তরা থেকে শেরপুর যাওয়ার সময় পথে ওই চক্রের হাতে অপহরণের শিকার হন হিমেল। পরে একাধিকবার ফোন করে হিমেলের নম্বরটি বন্ধ পায় তার পরিবার। খোঁজাখুঁজির পর হিমেলকে না পেয়ে তার মা উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি সাধারণ ডায়রি করেন।’

কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘২৮ ডিসেম্বর গাজীপুরের বাসন এলাকা থেকে পরিত্যক্ত অবস্থায় ভুক্তভোগীর গাড়িটি উদ্ধার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পরে অজ্ঞাত এক ব্যক্তি হিমেলের মায়ের হোয়াটসঅ্যাপে ফোন করে অপহরণের বিষয়টি জানায়। দুই কোটি টাকা মুক্তিপণ দাবি করে এবং নির্যাতনের ভিডিও পাঠায়। এ ঘটনায় ৬ জানুয়ারি হিমেলের মামা বাদী হয়ে উত্তরা পশ্চিম থানায় একটি অপহরণ মামলা করেন।’

তিনি বলেন, ‘পরে ছেলেকে উদ্ধারে র‌্যাবের কাছে একটি অভিযোগ দায়ের করেন হিমেলের মা। মামলার সূত্র ও অভিযোগের ভিত্তিতে হিমেলকে উদ্ধার এবং অপহরণকারীদের গ্রেফতারে গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ায় র‌্যাব। এরই ধারাবাহিকতায় মঙ্গলবার (২৩ জানুয়ারি) র‌্যাব সদর দফতর গোয়েন্দা শাখা, র‌্যাব-১, র‌্যাব-৯ ও র‌্যাব-১৪ এর আভিযানিক দল সুনামগঞ্জের তাহিরপুর এলাকা থেকে চক্রের মূলহোতা ও পরিকল্পনাকারী আব্দুল মালেক, তার অন্যতম সহযোগী ড্রাইভার ছামিদুল ইসলামকে গ্রেফতার করে। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বুধবার রাতে তাহিরপুর থেকে হিমেলকে উদ্ধার করা হয়। এ সময় রনি নাবালকে গ্রেফতার করে র‌্যাব। পরে গ্রেফতার ব্যক্তিদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে গত রাতে উত্তরা থেকে রাসেল মিয়া ও বিল্লাল হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়।’

তিনি বলেন, ‘মালেক ও ছামিদুল অপহরণ চক্রের মূলহোতা। হিমেলের বাসায় চার বছর ধরে গাড়ি চালক হিসেবে চাকরি করে ছামিদুল। সে ওই পারিবারের আর্থিক ও সম্পত্তি বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য জানতো। ১৬ ডিসেম্বর মালেকের নেতৃত্বে গ্রেফতার ব্যক্তিরা উত্তরার একটি জায়গায় সমবেত হয়। হিমেলকে অপহরণ করে পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায়ের পরিকল্পনার বিষয়টি অন্যান্য সহযোগীদের জানায় মালেক ও ছামিদুল। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ছামিদুল ভুক্তভোগীকে শেরপুরের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ব্যাটারি বিক্রির সম্ভাবনার কথা জানায়। তাকে সেখানে যেতে আগ্রহী করে। পরে ২৬ ডিসেম্বর হিমেল রওনা দিলে মালেককে বিষয়টি জানায় ছামিদুল।’

খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘পরিকল্পনা অনুযায়ী মালেক ও অন্যরা মোটরসাইকেল নিয়ে ভুক্তভোগীর গাড়ি অনুসরণ করতে থাকে। গাজীপুরের সালনায় পৌঁছালে গাড়িটি আটকায়। তারা ভুক্তভোগী ও ছামিদুলকে গাড়ির পেছনে বসায়। রনি ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে এবং রাসেল গাড়ি চালাতে থাকে। এ সময় মালেক ও অন্যরা মোটরসাইকেলে গাড়িটি অনুসরণ করতে থাকে। সন্ধ্যার দিকে তারা ময়মনসিংহের সীমান্তবর্তী এলাকা ধোবাউড়ায় পৌঁছায়। ওই এলাকায় তিন দিন অবস্থানের পর বিল্লাল ছাড়া চক্রের অন্য সদস্যরা হিমেলকে নিয়ে তাহিরপুরের সীমান্তবর্তী এলাকায় যায়।’

তিনি বলেন, ‘হিমেলের মাকে একটি হোয়াটসঅ্যাপ নম্বর থেকে ফোন করে মালেক। অপহরণের বিষয়টি জানিয়ে ২ কোটি টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। নির্যাতনের ভিডিও পাঠায়। পর্যায়ক্রমে সে ১ কোটি তারপর ৫০ লাখ তারপর ৩০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। টাকা না পেলে ভুক্তভোগীর হাত-পা কেটে ফেলা ও হত্যার হুমকি দেয়। মালেক বিভিন্ন সময় হিমেলের মাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে এবং তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার হুমকি দেয়।

পরে হিমেলের মা মুক্তিপণের টাকা দিতে রাজি হন। মঙ্গলবার (২৩ জানুয়ারি) চক্রের সদস্যরা তাকে তাহিরপুরে যেতে বলে। বিষয়টি তিনি র‌্যাবকে জানান। নির্ধারিত দিনে হিমেলের মা নেত্রকোনায় পৌঁছালে মালেক ও ছামিদুল তাকে তাহিরপুরে যেতে বলে। তখন গ্রেফতার করতে গেলে অভিযুক্তরা র‌্যাবের ওপর হামলা চালায়। এতে একজন কর্মকর্তাসহ দুই জন র‌্যাব সদস্য আহত হন। এ সময় মালেক ও ছামিদুলকে গ্রেফতার করা হয়।’

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন থানায় অপহরণ, অস্ত্র আইন, বিস্ফোরক আইন, ডাকাতি-ছিনতাই ও খুনসহ ১৪টির বেশি মামলায় মালেক আট বছরের বেশি সময় কারাভোগ করেছে। সর্বশেষ সে ময়মনসিংহের একজন অধ্যাপকের ছেলেকে অপহরণের ঘটনায় তিন বছর কারাভোগ করে। ছামিদুলও পেশায় গাড়ি চালক। সে মালেকের অন্যতম সহযোগী ছিল। রনি পেশায় অটো চালক। সে মালেকের অন্যতম প্রধান সহযোগী। মালেকের নির্দেশনায় বিভিন্ন সময় অপহৃতদের দেশের সীমান্তবর্তী পাহাড়ি ও দুর্গম এলাকায় আটকে রাখতো এবং নির্যাতন করতো। সে অস্ত্র ও ডাকাতিসহ দুইটি মামলায় ছয় বছরের বেশি সময় কারাভোগ করেছে। রাসেল ও বিল্লাল পেশায় গাড়ি চালক। তারা মালেকের সহযোগী। এই দুই জনও একাধিক মামলায় বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ করেছে।’