পদ্মার চরের শিশুদের জন্য শাহ আলমের স্বপ্নের বিদ্যালয়

প্রকাশিত: ৩:৩৫ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ৭, ২০২৪

শরীয়তপুর প্রতিনিধিঃ 

চারদিকে খরস্রোতা পদ্মা বেষ্টিত কয়েকটি গ্রাম, যেখানে এখনো মানুষের মূল পেশা মাছ শিকার ও কৃষিকাজ। একটু সচ্ছল পরিবারে জন্ম না হলেই ছেলে শিশুদের বাবার সঙ্গে মাছ শিকার আর মেয়ে শিশুদের মায়ের সঙ্গে গৃহস্থালির কাজ শিখতে হত। স্কুলের অভাবে সমবয়সীদের এমন পরিণতি মানতে পারেননি শহরের স্কুলপড়ুয়া কিশোর শাহ আলম মৃধা। তাই ছুটি পেলেই গ্রামে এসে স্কুলের দাবিতে সমবয়সীদের একত্র করে গ্রামের মেঠোপথ ধরে মিছিল-মিটিং করতেন।

কিশোর বয়সে ছেলের এমন কর্মকাণ্ড মানতে না পেরে শাহ আলমকে তার বাবা মারধরও করেন। মারধর করে মিছিল-মিটিং বন্ধ করতে পারলেও শাহ আলমের স্বপ্নকে দাবিয়ে রাখা যায়নি। পড়াশোনা শেষে চাকরি পেয়ে এ বছর গ্রামে একটি স্কুল গড়ে তুলেছেন তিনি। স্কুলের অভাবে এখন আর কাউকে যেতে হবে না মাছ শিকারে, শিখতে হবে না গৃহস্থালির কাজ। স্কুলটিতে এ বছরের শুরু থেকেই রঙিন বইয়ে জীবন রাঙাতে শুরু করেছে পদ্মার চরের শিশুরা।

সম্প্রতি এমনই তথ্য জানা যায়, শরীয়তপুরের সখিপুর থানার পদ্মা বেষ্টিত কাঁচিকাটা ইউনিয়নের মৃধা বাড়ি নবীন কুঁড়ি বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে। প্রথমবারের মতো স্কুলটিতে এ বছরের শুরু থেকেই শতাধিক শিক্ষার্থী পাঠদান শুরু করেছে। স্কুলটির উদ্যোক্তা কাঁচিকাটা ইউনিয়নের উত্তর মাথাভাঙা গ্রামের মজিবুর রহমান মৃধার ছেলে শাহ আলম মৃধা।

স্কুল ও তার আশপাশের গ্রামবাসীদের কাছ থেকে জানা যায়, উত্তর মাথাভাঙা, দক্ষিণ মাথাভাঙা গ্রামসহ কয়েকটি গ্রামের শিশুদের জন্য কোনো স্কুল ছিল না। পদ্মার ছোট ছোট শাখা পেরিয়ে দূরের স্কুলে যেতে চাইত না শিশুরা। তাছাড়া ছোট ছোট এসব শিশুদের অভিভাবকরাও দুর্ঘটনার ভয়ে দূরের স্কুলে পাঠাতেন না। যার ফলে গ্রামের প্রায় সকল শিশু ছোট বয়সেই বাবা মায়ের সঙ্গে মাছ ধরা ও কৃষিকাজ শিখত। নব্বইয়ের দশকে শাহ আলম মুন্সীগঞ্জ শহরের একটি স্কুলে পড়াশোনা করতেন। সেই স্কুলের ছুটিতে বাড়িতে এসে তার সমবয়সী গ্রামের সব কিশোর-কিশোরীদের একত্র করে গ্রামের মেঠোপথ, ফসলি মাঠের আইল দিয়ে স্কুলের দাবিতে মিছিল শুরু করে। বয়সে ছোট বলে শাহ আলমের এমন কর্মকাণ্ড গ্রামবাসী গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু শাহ আলমের প্ররোচনায় অধিকাংশ বাচ্চারা যখন প্রতিনিয়ত এমন কাণ্ড করতেই থাকে, তখন গ্রামবাসী বিরক্ত হয়ে তার বাবার কাছে বিচার দিলে একদিন শাহ আলমকে তার বাবা গালাগালিসহ মারধর করেন। এরপর অবশ্য শাহ আলম আর গ্রামের শিশুদের একত্র করে স্কুলের দাবিতে মিছিল-মিটিং করেননি। মুন্সীগঞ্জের মাকহাটি জি.সি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এলাকার প্রথম সন্তান হিসেবে এসএসসি, সরকারি হরগঙ্গা কলেজ থেকে যথাক্রমে এইচএসসি ও বিএ পাস করেন শাহ আলম।

বর্তমানে ঢাকার একটি বেসরকারি ট্রাভেল এজেন্সিতে চাকরি করছেন শাহ আলম (৩৫)। পড়াশোনা শেষে চাকরি নিয়ে গ্রামে এসে আবার স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলা শুরু করেন তিনি। এবার আর তার কথায় কেউ দ্বিমত করেনি। যে গ্রামবাসী একদিন বিচার দিয়ে শাহ আলমকে তার বাবার হাতে মার খাইয়েছিল, সেই গ্রামবাসীই তার বাবাকে স্কুল প্রতিষ্ঠার জন্য উৎসাহ দিলে তার বাবা স্কুলের জন্য রাস্তার পাশের ৩৩ শতাংশ জমি দান করেন। এরপর গ্রামবাসী, প্রবাসীসহ সকলের সহযোগিতায় গত বছরের ডিসেম্বর মাসে স্কুলটি গড়ে তোলেন শাহ আলম। গ্রামবাসী ও শাহ আলমের সহযোগিতায় একটি টিনশেড ভবনের চারটি কক্ষের স্কুলটিতে বর্তমানে ১২০ জনের বেশি শিক্ষার্থী রয়েছে। সব কিছু সুন্দরভাবে চললেও স্কুলটিতে এখনো বেঞ্চ ও ব্লাকবোর্ড ছাড়া প্রাক-প্রাথমিকের শিশুদের খেলনা, অফিসের আসবাবপত্র, টয়লেট, ফ্যান ও লাইট নেই। পড়াশোনার জন্য শিশুদের মধ্যে যে উৎসাহ ও আনন্দ লক্ষ করা যাচ্ছে, তাতে সকলের সহযোগিতায় এসব সংকটও দ্রুত সমাধান হয়ে যাবে। গ্রামবাসীদের এখন একটাই দাবি, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও শিক্ষা অফিসের কর্মকর্তারা যদি সরকারি স্কুলের মতো শিক্ষকদের প্রশিক্ষণসহ স্কুলের মান উন্নয়ন ও স্কুলটি সরকারিকরণে সহযোগিতা করত, তাহলে শিক্ষার সুযোগবঞ্চিত এসব শিশু অন্য শিশুদের মতো সুন্দরভাবে এগিয়ে যেতে পারত।

স্থানীয় জসিম উদ্দিন খান বাবুর ছেলে নিরব স্কুলটিতে প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়েছে। তিনি  বলেন, চারপাশে নদী ও দুর্গম অঞ্চল হওয়ায় আমার ছেলের স্কুলে যাওয়া হত না। শাহ আলমের গড়া স্কুলে গিয়ে এখন প্রতিদিন শিক্ষার আলোয় আলোকিত হচ্ছে আমার ছেলে। শাহ আলম প্রত্যন্ত এই চরাঞ্চলে স্কুল গড়ে এখানকার ছেলে-মেয়েদের পড়াশোনার সুযোগ করে দিয়েছেন। তাকে আমরা সাধুবাদ জানাই।

স্কুলটির স্বপ্নদ্রষ্টা শাহ আলম মৃধা নিউজ পোস্ট বিডিকে  বলেন, গ্রামের যে মেঠোপথ ধরে একদিন স্কুলের দাবিতে মিছিল করে বাবার হাতে মার খেয়েছি, সেই মেঠোপথের সবুজ ঘাস মাড়িয়ে এখন শিক্ষার সুযোগবঞ্চিত শিশুরা স্কুলে আসে। এই দৃশ্য যখন দেখি, তখন আমি সব কষ্ট ভুলে যাই। পদ্মা বেষ্টিত কাঁচিকাটার শিশুরাও একদিন পৃথিবীর সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যাবে, এখন আমার এই একটাই স্বপ্ন।

শাহ আলমের বাবা মজিবুর রহমান মৃধা  বলেন, শাহ আলম যখন স্কুলে পড়ত, তখন ছুটি পেলেই বাড়িতে এসে গ্রামের ছেলেদের নিয়ে স্কুলের দাবিতে মিছিল-মিটিং করত। গ্রামবাসীর চাপে একসময় ওকে আমি গালিগালাজসহ মারধরও করেছি। আল্লাহর রহমতে ছেলে আমার বিএ পাস করে এখন চাকরি করে। আমি তাকে বলেছিলাম, চাকরির টাকা দিয়ে বাড়িতে ঘর তুলতে। কিন্তু সে ঘর তুলবে না, স্কুল গড়বে। ছেলের বায়না ও গ্রামবাসীর প্রয়োজনে আমি স্কুলের নামে জমি দলিল করে দিয়েছি। স্কুলে এখন গ্রামের শিক্ষাবঞ্চিত ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করে। বিষয়টি দেখতে আমার কাছে বেশ ভালো লাগে।স্কুলটির সভাপতি বাদশাহ দেওয়ান ঢাকা পোস্টকে বলেন, দুর্গম চরাঞ্চলে স্কুলটি হওয়ার পর সবার সহযোগিতায় স্কুলটি পরিচালনা করছি। সরকারের কাছে একটাই দাবি স্কুলটি সরকারিকরণ করা হোক।

কাঁচিকাটা ইউনিয়ন পরিষদের ৩নং ওয়ার্ডের সদস্য আহমদ আলী মৃধা  বলেন, শাহ আলম ছোটবেলা থেকেই একটি স্কুলের স্বপ্ন দেখেছিল। বড় হয়ে চাকরি পেয়ে সে সকলের সহযোগিতায় স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছে। স্কুলে গ্রামের শিশুরা পড়াশোনা করছে। স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে স্কুলটি সরকারিকরণে কাজ করবো।

ভেদরগঞ্চ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রাজিবুল ইসলাম  বলেন, কাঁচিকাটা প্রত্যন্ত একটি চরাঞ্চল। প্রত্যন্ত অঞ্চলের নতুন এই স্কুলের শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করতে আমি শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অনুরোধ করবো। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সরকারি বিধি অনুযায়ী স্কুলটিকে সরকারিকরণ করতে উপজেলা প্রশাসন কাজ করবে।