নাশকতার আগুনে বেনাপোল এক্সপ্রেসের আড়াই কোটি টাকার ক্ষতি

প্রকাশিত: ৩:২৫ অপরাহ্ণ, জানুয়ারি ৯, ২০২৪

সাইফুল ইসলাম:

রাজধানীর গোপীবাগে বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে দুর্বৃত্তের দেওয়া আগুনে নারীসহ অন্তত চারজনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া আগুনে ট্রেনের তিনটি বগি পুড়ে যায়। এসময় ট্রেনের শিকল টানলে তাতে কাজ করেনি। বেনাপোল এক্সপ্রেসে আগুনে হতাহত ছাড়াও রেলওয়ের আনুমানিক আড়াই কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, শুক্রবার (৫ জানুয়ারি) রাত ৯টার দিকে চলন্ত ট্রেনটিতে আগুন দেয় দুর্বৃত্তরা। এ ঘটনায় পরদিন বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনের পরিচালক (গার্ড) এসএম নুরুল ইসলাম (৫৭) বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন। মামলার এজাহারে এ কথা উল্লেখ করেন বাদী।

ট্রেনের শিকল টানলেও তা কাজ করেনিঃ
মামলার এজাহারে বাদী উল্লেখ করেন, গত ৫ জানুয়ারি দুপুর ১টার সময় ঢাকাগামী বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনটি বেনাপোল রেলওয়ে স্টেশন থেকে ঢাকার উদ্দেশে রওনা করে। ট্রেনটি রাত আনুমানিক ৯টার সময় ট্রেনটি সায়েদাবাদ এলাকা পৌঁছানো মাত্র ট্রেনের ৭৯৩৭ নম্বর কোচের বগি ‘চ’ তে ধোঁয়া দেখে চিৎকার শুরু করেন যাত্রীরা। তখন ওই বগিতে ডিউটিতে থাকা মোহাম্মদ আলী আগুন আগুন বলে চিৎকার করে যাত্রীদের সতর্ক হতে বলে এবং টেনের শিকল টেনে থামানোর চেষ্টা করেন। কিন্তু তাতে কাজ না হওয়ায় আমি (বাদী) ভ্যাকুয়াম প্রেস করে ট্রেনটি থামানো হয়। রাত আনুমানিক ৯টা ২মিনিটের দিকে গোপীবাগ ও গোলাপবাগের মাঝামাঝি জামে মসজিদের সামনে ট্রেনটি থামে। ততক্ষণে আগুন দাউ দাউ করে ‘চ’ বগি থেকে ‘ছ’ বগিতে এবং ‘পাওয়ার কার নম্বর ৭৫২৬ ‘ভ’ বগিতে ছড়িয়ে পড়ে। তখন আমি তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অবহিত করে ট্রেনে থাকা অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র দিয়ে আগুন নেভানোর চেষ্টা করি এবং জরুরি ভিত্তিতে ফায়ার সার্ভিসের একাধিক টিম পাঠানোর অনুরোধ করি।

তিনি আরও উল্লেখ করেন, অল্পসময়ের মধ্যেই ফায়ার সার্ভিসের কয়েকটি ইউনিট ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছায়। ফায়ার সার্ভিস রেলওয়ে পুলিশ, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব), বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনী (আরএনবি), ডিএমপি পুলিশসহ ঘটনাস্থলে উপস্থিত লোকজনের সহায়তায় রাত সাড়ে ১০ টার দিকে ট্রেনের তিনটি বগির আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়। আগুন নেভানোর পর ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধারকারী দল, রেলওয়ে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, আরএনবি ও ডিএমপি পুলিশের সহায়তায় তল্লাশি চালিয়ে ‘চ’ বগি থেকে একজন নারীসহ চারজনের বিকৃত মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এছাড়া ট্রেন থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে ১০/১২জন যাত্রী গুরুতর আহত হন। তারা বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছে বলে জানতে পারি। পরবর্তীতে রেলওয়ে পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস সদস্যরা মরদেহগুলো ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে পাঠায়।

যাত্রীদের হত্যা ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের ক্ষতিসাধনে ট্রেনে অগ্নিসংযোগঃ
অজ্ঞাতনামা দুষ্কৃতিকারীরা পূর্ব-পরিকল্পিতভাবে পরস্পর যোগসাজশে নাশকতা করে যাত্রীদের হত্যা ও রাষ্ট্রীয় সম্পদের ব্যাপক ক্ষতিসাধনের উদ্দেশ্যে রাত ৯টা থেকে ৯টা দুই মিনিটের দিকে দাহ্য পদার্থ দ্বারা ট্রেনে আগুন ধরিয়ে দেয়। ঢাকা রেলওয়ে থানার গোপীবাগ ও গোলাপবাগের মাঝামাঝি গোলাপবাগ জামে মসজিদের সামনে গোপীবাগ রেলক্রসিং হতে অনুমানিক ১৫০ গজ দক্ষিণে বেনাপোল এক্সপ্রেসের ‘চ’, ‘ছ’ ও ‘ভ’ বগিতে এ ঘটনা ঘটায়। ট্রেনের চারজন যাত্রীকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। এছাড়া অনেকে আহত হয়েছেন। এ ঘটনায় রেলওয়ের অনুমানিক দুই কোটি ৫০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। রেলওয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সরেজমিনে পরিদর্শন করেছেন। অজ্ঞাতনামা আসামিদের নাম-ঠিকানা সংগ্রহের চেষ্টা করে এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনার কারণে এজাহার দায়েরের ক্ষেত্রে বিলম্ব হলো।

চারজনের মরদেহ শনাক্তে ডিএনএ পরীক্ষার অনুমতিঃ
বেনাপোল এক্সপ্রেসে আগুন দেওয়ার ঘটনায় করা মামলায় মৃত চারজনের ডিএনএ পরীক্ষার জন্য আদালতে আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ঢাকা রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফেরদৌস আহমেদ বিশ্বাস। গত রোববার (৭ জানুয়ারি) ঢাকার চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে আবেদন করলে তা আবেদন মঞ্জুর করেন আদালত।

আবেদনে তদন্তকারী কর্মকর্তা বলেন, চলন্ত ট্রেনে আগুন দেওয়ার ঘটনায় চারজন যাত্রী মৃত্যুবরণ করেন। মরদেহগুলো দেখে শনাক্তের কোনো সুযোগ নেই। এমতাবস্থায় সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুত শেষে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসকের মাধ্যমে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করা হয়। ওই মরদেহগুলোকে চারজন ব্যক্তি তাদের নিকটাত্মীয় দাবি করেন। এর মধ্যে একটি মরদেহকে আবু তালহা (২৫) নামে এক ব্যক্তি তার বাবা আ. হকের (৫০) মরদেহ বলে দাবি করেন। আ. হকের বাড়ি রাজবাড়ী জেলার কালুখালী উপজেলার গনবথনদিয়া গ্রামে। আরেক মরদেহকে ডা. দিবাকর চৌধুরী (৩৫) বলে উল্লেখ করেন তার ছোটবোন চন্দ্রিমা চৌধুরী (২৮)। ডা. দিবাকর রাজবাড়ী সদরের রঘুনাথপুর গ্রামের চিত্তরঞ্জন চৌধুরীর ছেলে। অন্য আরেকটি মরদেহকে মো. খুরশিদ আহমেদ (৩৭) বলে দাবি করেন তার ছোটবোন নাতাসা জেসমিন নেকী (২৫)। তিনি ঢাকার গেণ্ডারিয়ায় বাসিন্দা ছিলেন। বাকি মরদেহটিকে মনিরুজ্জামান মামুন (৩০) বলে দাবি করেন তার ছোটবোন এলিনা ইয়াসমিন (৪৩)। তিনি রাজবাড়ী সদরের লক্ষীকোল গ্রামের সাইদুর রহমান বাবুর ছেলে বলে উল্লেখ করেন তার বোন এলিনা ইয়াসমিন। এমতাবস্থায় মরদেহগুলোর পরিচয় শনাক্তে দাবিদারদের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে ডিএনএ প্রোফাইলের সঙ্গে ম্যাচিং করানো একান্ত প্রয়োজন বলে করেন তদন্ত কর্মকর্তা। কাজ করেনি শিকল, আগুনে বেনাপোল এক্সপ্রেসের ক্ষতি আড়াই কোটি টাকাবেনাপোল এক্সপ্রেসে উদ্ধার কাজে ব্যস্ত ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা

মরদেহ দাবিদারদের ডিএনএ নমুনা সিআইডির ফরেনসিকে পাঠানোর অনুমতিঃ
মরদেহ দাবিদারদের ডিএনএ নমুনা পৃথকভাবে সংগ্রহ পরিচয় শনাক্তের জন্য পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফরেনসিক বিভাগে পাঠানোর জন্য আদালতে আবেদন করা হয়। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা গত রোববার আবেদন করলে তা মঞ্জুর করেন ঢাকার চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত। আবেদনে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা উল্লেখ করেন, পরিচয় শনাক্তের জন্য মরদেহগুলোর ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করে ডিএনএ প্রোফাইল তৈরির জন্য আদালতে আবেদন করা হয়েছে। এমতাবস্থায় মরদেহ দাবিদারদের ডিএনএ সমুনা সংগ্রহ করে তা ম্যাচিং করিয়ে পরিচয় শনাক্তে আদেশনামা একান্ত প্রয়োজন।

এ বিষয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ফেরদৌস আহমেদ বিশ্বাস নিউজ পোস্টকে বলেন, বেনাপোল এক্সপ্রেস ট্রেনে আগুন দেওয়ার ঘটনায় করা মামলায় এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। মামলার তদন্তের পাশাপাশি আসামিদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে।