তামাক কোম্পানির কূটকৌশল রোধে যুগোপযোগী আইন প্রয়োজন

প্রকাশিত: ৩:৩৬ অপরাহ্ণ, মে ৩০, ২০২৪

নিজস্ব প্রতিবেদক:

তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে তামাক পণ্যের প্রচার ও বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ হলেও এর কার্যকর বাস্তবায়নের অভাবে তামাক কোম্পানির কূটকৌশলে অরক্ষিত হয়ে পড়েছে দেশের তরুণরা। এছাড়া সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কিছু কর্মকর্তার তামাক কোম্পানিকে ছাড় দেওয়ার মানসিকতাও এর জন্য দায়ী। তাই বিদ্যমান ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন, ২০০৫ (সংশোধিত ২০১৩) যুগোপযোগী করে তরুণদের রক্ষার দাবি জানিয়েছে ঢাকা আহছানিয়া মিশন ইয়ুথ ফোরাম ফর হেলথ এন্ড ওয়েলবিং।
বৃহস্পতিবার (৩০ মে) দুপুরে শ্যামলিস্থ ঢাকা আহছানিয়া মিশন, স্বাস্থ্য সেক্টরের অডিটোরিয়ামে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানানো হয়।

বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস-২০২৪ উপলক্ষ্যে ‘তামাক কোম্পানির হস্তক্ষেপ প্রতিহত করি, শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করি’ শীর্ষক সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ক্যাম্পেইন ফর টোব্যাকো ফ্রি কিডস (সিটিএফকে) এর, প্রোগ্রামস ম্যানেজার মো. আব্দুস সালাম মিয়া ও ঢাকা আহছানিয়া মিশন, স্বাস্থ্য ও ওয়াশ সেক্টরের পরিচালক, ইকবাল মাসুদ।
সংবাদ সম্মেলনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ইয়ুথ ফোরাম সদস্য মো. তাসনিম হাসান আবীর ও নাসিম হাসান।
মূল প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়, তামাকই পৃথিবীর একমাত্র বৈধ পণ্য, যা অবধারিতভাবে তার ভোক্তাকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। এক প্রজন্মের তামাকসেবী যখন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে কিংবা ঘাতক ব্যাধির প্রকোপে তামাক সেবন ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়, ব্যবসা টিকিয়ে রাখতেই তামাক কোম্পানিগুলো নতুন প্রজন্মের তামাকসেবী তৈরির লক্ষ্যে মোহনীয় বিজ্ঞাপনের ফাঁদ পেতেছেন। যে কারণে কিশোর-কিশোরীরা আজ ঠোঁটে তামাকপণ্য তুলে নিচ্ছে, কাল সেই পরিণত হচ্ছে তামাক কোম্পানির আমৃত্যু খদ্দেরে।

কেবল বাংলাদেশেই তামাক ব্যবহারজনিত মৃত্যুতে তামাক কোম্পানিগুলোকে বছরে ১ লক্ষ ৬১ হাজার ভোক্তা হারাতে হয়। ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে তাই সর্বদা চলে নতুন ভোক্তা তৈরির কাজ। তামাক কোম্পানির কূটচাল সম্পর্কে তরুণ প্রজন্মকে অবহিত করা এবং এসব অপতৎপরতা মোকাবিলায় উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে এ বছর বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস-এর প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে “প্রোটেক্টিং চিলড্রেন ফ্রম টোব্যাকো ইন্ডাস্ট্রি ইন্টারফেয়ারেন্স”। ২০৪০ সালের মধ্যে ‘তামাকমুক্ত বাংলাদেশ’ অর্জনের লক্ষ্য পূরণে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন এবং কার্যকর তামাক কর ও মূল্য পদক্ষেপ বাস্তবায়ন এখন সময়ের দাবি। কিন্তু উদ্ভাবনী কৌশল এবং আকর্ষণীয় ডিজাইনে তামাকপণ্য বাজারজাতকরণে উঠতি বয়সীদের মাঝে বিশেষত বিদ্যালয়গামী শিশুদের মধ্যে এসব তামাকপণ্য জনপ্রিয়তা লাভ করতে শুরু করেছে।

অল্পবয়সীদেরকে নির্দিষ্ট ব্র্যান্ডে আসক্ত করতে কোম্পানিগুলো নানা ধরনের কূটকৌশলের আশ্রয় নেয়, চিত্তাকর্ষক নিত্যনতুন ব্র্যান্ড ও স্বাদের তামাকপণ্য বাজারজাতকরণ। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সুগন্ধিযুক্ত ই-সিগারেট ও ভেপিং পণ্য বাজারজাত করছে তামাক কোম্পানিগুলো।

শিক্ষার্থীদের আকৃষ্ট করতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশে বা সামনের দোকানগুলোতে তামাকপণ্য সহজলভ্য করে তোলা হচ্ছে। বিশেষত, শিশুদের পছন্দের খাবার যেমন, ক্যান্ডি, চিপস ইত্যাদির কাছাকাছি তামাক পণ্যগুলো সাজানো এবং বিক্রেতাদের বিভিন্ন বিপণন সরঞ্জাম প্রদর্শন করা হচ্ছে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, স্ট্রিমিং সার্ভিস ইত্যাদিতে তামাকপণ্যের বিজ্ঞাপন এবং তরুণদের প্রভাবিত করতে অর্থের বিনিময়ে ব্যবহার করা হচ্ছে মিডিয়া সেলিব্রেটি ও প্রভাবশালীদের। উঠতি বয়সীদের কাছে জনপ্রিয় এমন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তামাক কোম্পানির পৃষ্ঠপোষকতা কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তামাক কোম্পানির সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন চিত্তাকর্ষক অনুষ্ঠান (জব ফেয়ার, ব্যাটল অব মাইন্ডস ইত্যাদি)-এর আয়োজনও কিন্তু তামাককেই উৎসাহিত করছে। পাশাপাশি খুচরা (একক শলাকা), বিনামূল্যে কিংবা বিশেষ ছাড়ে বাজারজাত করার মাধ্যমে তামাক পণ্যকে আরও সহজলভ্য করে তুলছে।

পরিসংখ্যান তুলে ধরে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, বাংলাদেশে ১৫ বছর ও তদূর্ধ্ব জনগোষ্ঠীর মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার ৩৫.৩ শতাংশ। টোব্যাকো অ্যাটলাস এর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বাংলাদেশে ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সীদের মধ্যে তামাক ব্যবহারকারীর হার ছিল ৬ শতাংশ।

অন্যদিকে, ২০১৪ সালে পরিচালিত গ্লোবাল স্কুল-বেজড হেলথ সার্ভে (জিএসএইচএস) অনুযায়ী, বাংলাদেশে ১৩-১৫ বছর বয়সী ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে তামাক ব্যবহারের হার ৯.২ শতাংশ। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনে তামাক পণ্যের প্রচার ও বিজ্ঞাপন নিষিদ্ধ হলেও কার্যকর বাস্তবায়নের অভাবে তামাক কোম্পানির লোভের মুখে অরক্ষিত হয়ে পড়েছে দেশের তারুণ্য।

২০১৭ সালে দেশের ৮টি বিভাগীয় শহর, ৪টি জেলা শহর ও ১১টি উপজেলার গ্রামাঞ্চলে ১৮০টি স্কুলের পারিপার্শ্বিক এলাকার ওপর ঢাকা আহছানিয়া মিশন পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা যায়, ৯০.৬ শতাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও খেলার মাঠে তামাক পণ্যের বিক্রয় কেন্দ্র পাওয়া গেছে। প্রতিটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাশে ৪টি এরকম তামাক পণ্য বিক্রয় কেন্দ্র রয়েছে। ৬৮ শতাংশ বিক্রয়কেন্দ্রে চকলেট, ক্যান্ডি, কোমল পানীয় ইত্যাদির পাশেই তামাক পণ্য প্রদর্শন করতে দেখা গেছে।

তামাক মুক্ত দেশ অর্জনে আহছানিয়া মিশন ইয়ুথ ফোরামের পাঁচ দফা সুপারিশ

বাংলাদেশে বর্তমান মোট জনগোষ্ঠীর ৪৮ শতাংশই তরুণ-তরুণী। তামাক কোম্পানির মূল টার্গেট কিভাবে এই বিশাল জনগোষ্ঠীকে তামাকে আসক্ত করে ব্যবসা বাড়ানো যায়। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের উচিত তামাক কোম্পানির ছোবল থেকে এদেরকে সুরক্ষা প্রদান করা। তামাকাসক্ত অসুস্থ প্রজন্ম দেশের অগ্রগতির হাতিয়ার না হয়ে বরং সমাজ ও অর্থনীতির জন্য বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।

১। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের খসড়া সংশোধনী দ্রুত চূড়ান্তকরণের মাধ্যমে বিক্রয়স্থলে তামাক পণ্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ, ‘ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান’ বিলুপ্ত, ই-সিগারেটসহ সকল ভ্যাপিংপণ্য নিষিদ্ধ এবং তামাক কোম্পানির সিএসআর কার্যক্রম বন্ধসহ আইনের অন্যান্য ধারার কঠোর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
২। স্বাস্থ্য উন্নয়ন সারচার্জের অর্থ ব্যবহার করে জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ নীতি/কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।

৩। অবিলম্বে সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাটল অব মাইন্ডস এবং তামাক কোম্পানির পৃষ্ঠপোষকতায় আয়োজিত যেকোনো ধরনের অনুষ্ঠান নিষিদ্ধ করতে হবে।

৪। তামাক কোম্পানির কূটকৌশল ও হস্তক্ষেপ মোকাবিলায় এফসিটিসি আর্টিক্যাল ৫.৩ অনুসারে নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে।

৫। তামাক পণ্যের দাম কার্যকরভাবে বাড়িয়ে অল্পবয়সী জনগোষ্ঠীর ক্রয়ক্ষমতার বাইরে নিয়ে যেতে হবে।

স্বাগত বক্তব্যে আহছানিয়া মিশন ইয়ুথ ফোরাম ফর হেলথ এন্ড ওয়েলবিং সমন্বয়কারী মারজানা মুনতাহা জানান, তামাক কোম্পানির কূটকৌশল ও হস্তক্ষেপ মোকাবেলায় এফসিটিসি আর্টিক্যাল ৫.৩ অনুসারে নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। পাশাপাশি, তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের খসড়া সংশোধনী দ্রুত চূড়ান্তকরণের মাধ্যমে বিক্রয়স্থলে তামাকপণ্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ, ‘ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান’ বিলুপ্ত, ই-সিগারেটসহ সকল ভ্যাপিংপণ্য নিষিদ্ধ এবং তামাক কোম্পানির সিএসআর কার্যক্রম বন্ধসহ আইনের অন্যান্য ধারার কঠোর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।