ঢাবি অধ্যাপকের স্ত্রীর মৃত্যুর তদন্তে নাটকীয় মোড়, ‘হত্যা’ হয়ে গেল আত্মহত্যা

প্রকাশিত: ১১:৪৭ পূর্বাহ্ণ, মে ৫, ২০২৪

মোঃ সাইফুল ইসলামঃ 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) প্রাণরসায়ন বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক কে বি এম মামুন রশিদ চৌধুরীর স্ত্রী কোহিনূর বেগম হত্যা মামলার তদন্তে নাটকীয় মোড় নিয়েছে। এর আগে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে এ ঘটনাকে ‘হত্যা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়; স্বজনের অভিযোগও ছিল তাই। তবে তদন্ত সংস্থা পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) বলছে, অসুস্থতাজনিত হতাশা থেকে কোহিনূর আত্মহত্যা করেন। সম্প্রতি আদালতে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে তারা বেশ কিছু তথ্য-প্রমাণও উপস্থাপন করেছেন। অবশ্য মৃতের ভাই ক্যাপ্টেন (অব.) সালাহউদ্দীন ম. রহমতুল্লাহ তদন্তে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তিনি আদালতে নারাজি আবেদন করবেন বলেও জানিয়েছেন।

পিবিআই ঢাকা মহানগরের বিশেষায়িত তদন্ত ও অভিযান (সংঘবদ্ধ অপরাধ-দক্ষিণ) শাখার এসআই শাহীন মিয়া সমকালকে বলেন, সার্বিক তদন্তে পাওয়া সাক্ষ্য-প্রমাণ, সাক্ষীদের জবানবন্দি, স্থানীয় গণ্যমান্য নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের দেওয়া তথ্য, পারিপার্শ্বিক ও দালিলিক সাক্ষ্য এবং সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনায় হত্যার প্রমাণ মেলেনি। ঘটনার সময় কোহিনূর একাই বাসায় ছিলেন। তিনি বাইপোলার মুড ডিজঅর্ডারে ভুগছিলেন। চিকিৎসকদের মত অনুযায়ী, এ ধরনের রোগীরা আত্মহত্যার মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

ধানমন্ডির ১১ নম্বর সড়কের ২০/এ নম্বর বাড়িতে পরিবারের সঙ্গে থাকতেন ৬৫ বছর বয়সী ফার্মাসিস্ট কোহিনূর বেগম। ২০২৩ সালের ১০ এপ্রিল দুপুরে সেখানে তাঁর নিথর দেহ পাওয়া যায়। স্বামীর ভাষ্য, তিনি চাবি দিয়ে দরজার তালা খুলে ঘরে ঢুকে সিলিং ফ্যানের সঙ্গে ওড়না দিয়ে গলায় ফাঁস দেওয়া অবস্থায় স্ত্রীকে দেখতে পান। দ্রুত তাঁকে নামিয়ে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। এ ঘটনায় প্রথমে অস্বাভাবিক মৃত্যু (ইউডি) মামলা হয়। তবে ময়নাতদন্তে হত্যার বিষয়টি উঠে আসার পর মৃতের ভাই বাদী হয়ে ভগ্নিপতি ও তাঁর পালিত কন্যার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন।

তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা জানান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মাসি বিভাগে পড়ালেখা করা কোহিনূর সর্বশেষ রেনেটা ফার্মাসিউটিক্যালসের মার্কেটিং ম্যানেজার ছিলেন। বিয়ের পর আনুমানিক ১৪ বছর পর্যন্ত তাদের কোনো সন্তান হয়নি। পরে স্বামী-স্ত্রী সিদ্ধান্ত নিয়ে চার দিন বয়সের এক মেয়েশিশুকে দত্তক নেন। এর প্রায় দুই বছর পর তাদের একটি ছেলে হয়। কোহিনূর বাইপোলার ডিজঅর্ডারে ভুগছিলেন। তিনি অধ্যাপক ডা. এম এ মোহিত কামালের কাছে চিকিৎসা নিতেন। এক পর্যায়ে তাঁর অধীনে গ্রিন রোডের ব্রেন অ্যান্ড লাইফ হাসপাতালে ভর্তিও ছিলেন। হাসপাতালের পক্ষ থেকে রোগের বিষয়ে জানানো হয়, ধানমন্ডির ল্যাবএইড হাসপাতালে ২০১৯ সালের ২১ অক্টোবর প্রথম তাঁকে দেখানো হয়। তখন বাইপোলার ডিজঅর্ডার ধরা পড়ে। অভিভাবকদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সেটি ছিল দ্বিতীয় অ্যাটাক। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। দেখা যায়, মানসিক রোগের পাশাপাশি তিনি হাইপোথাইরয়ডিজম এবং ডায়াবেটিসেও ভুগছিলেন।

বাইপোলার ডিজঅর্ডারের কারণে রোগীর মনে বিষাদ হানা দিতে পারে, চুপচাপ হয়ে যেতে পারেন, একাকী হয়ে যেতে পারেন, যাপিত জীবন নিরানন্দ মনে হতে পারে, নিজেকে অপ্রয়োজনীয় ভাবতে পারেন। গুরুতর অবস্থায় রোগী মরে যাওয়ার কথা ভাবতে পারেন। কোহিনূরের মধ্যেও এমন কিছু লক্ষণ ছিল। তিনি মাঝেমধ্যে বলতেন, ‘আমি তোমাদের বোঝা হয়ে গেছি, তাই না?’

তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, ঘটনার দিন পরিবারের সদস্যদের প্রত্যেকের বাসা থেকে বের হওয়া এবং ঢোকার সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করা হয়েছে। প্রযুক্তির সহায়তায় নির্ণয় করা হয়েছে তাদের অবস্থান। তাদের মধ্যকার কথোপকথন বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তবে ঘটনার সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি। আবার অন্য কেউ বাসায় ঢোকেওনি। পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি ও তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে এ ঘটনাকে আত্মহত্যা বলে প্রতীয়মান হয়।মামলার বাদী বিমান দুর্ঘটনা তদন্ত কমিটির প্রধান ক্যাপ্টেন (অব.) সালাহউদ্দীন ম. রহমতুল্লাহ বলেন, প্রকৃত ঘটনা তদন্তে উঠে আসেনি। ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনকে আমলে নেননি তদন্ত কর্মকর্তা। সেই সঙ্গে মনে হয়েছে, তিনি আত্মহত্যা প্রমাণ করতেই জোর দিয়েছেন।