গাজায় সাবেক ভারতীয় সেনা হত্যা, সরকারের নীরবতায় ক্ষোভ

প্রকাশিত: ৪:১০ অপরাহ্ণ, মে ১৬, ২০২৪

আন্তর্জাতিক ডেস্ক রিপোর্টঃ 

গাজার দক্ষিণাঞ্চলীয় নগরী রাফাহর কাছে সোমবার জাতিসংঘের একটি গাড়িতে ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় নিহত হন ভারতের সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও জাতিসংঘের ইউএনডিএসএস এর নিরাপত্তা সমন্বয় কর্মকর্তা বৈভব অনিল কালে। এ ঘটনায় জাতিসংঘ ও ভারতের পক্ষ থেকে পৃথক বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। জাতিসংঘ এ হত্যাকাণ্ডের জন্য সরাসরি ইসরায়েলি বাহিনীকে দায়ী করলেও ভারতের পক্ষ থেকে শুধু সমবেদনা জানিয়ে বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে এ ঘটনায় শক্ত পদক্ষেপ না নেওয়া ও ইসরায়েলি সরকার দায় শিকার না করায় খেপেছেন দেশটির সাবেক আমলারা। তারা বলছেন, এ হত্যাকাণ্ড নেতানিয়াহু সরকারের প্রতি ভারতীয় সরকারের নিঃশর্ত সমর্থনের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা।

গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় সাবেক ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা বৈভব অনিল কালে এর নিহতের ঘটনায় দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিকে অসন্তোষজনক বলে সমালোচনা করেছেন ইরানে ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত কে.সি. সিং। তিনি বলেন, ‘এই বিবৃতি অত্যন্ত হতাশাজনক। এই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে নেতানিয়াহু সরকারের প্রতি ভারতীয় সরকারের নিঃশর্ত সমর্থনের বিশ্বাসঘাতকতা। এমনকি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনও ভারতীয় সাবেক সেনা এবং জাতিসংঘের কর্মচারী হত্যা ঘটনায় চুপ থেকেছেন। তিনি এ ঘটনায় নিন্দা জানাননি।’ আর ভারত সরকারের জোরাল পদক্ষেপ না নেওয়াকে জায়নবাদ-হিন্দুত্ব জোট নাকি অদূরদর্শী কূটনীতি সেই প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।

জাতিসংঘে ভারতের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি টি.এস. তিরুমূর্তি গাজায় অনিল কালের হত্যাকে অগ্রহণযোগ্য বলে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, এ হত্যাকাণ্ডের জন্য দোষীকে জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। শুধু জাতিসংঘ বা দোষীরা নিছক শোক প্রকাশ করে যেন পার না পায়।উল্লেখ ২০২১ সালে টি.এস. তিরুমূর্তি সভাপতিত্বে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে রেজল্যুশন ২৫৮৯ সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছিল, যেখানে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কর্মীদের হত্যা এবং সহিংসতার জন্য জবাবদিহিতার আওতায় আনার একটি রেজল্যুশন।

অবসরপ্রাপ্ত ভারতীয় রাষ্ট্রদূত অমর সিনহা বলেছেন, ভারতীয় বিবৃতিতে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থার কর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সব পক্ষের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়টি উল্লেখ করা উচিত ছিল। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিটি অসম্পূর্ণ বলে দাবি করেন তিনি।

ভারতীয় সাবেক এ রাষ্ট্রদূত মনে করেন, ‘যুদ্ধেরও একটা নিয়ম আছে। সংঘাতের সময় জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো যারা যুদ্ধে অংশ নেয় না তাদের প্রতি নিরপেক্ষ আচরণ ও সম্মান দেখাতে হয়। এ বিষয়টি নিশ্চিত করা উচিত। আর ভারতীয় সেনা হত্যার ঘটনায় দোষী রাষ্ট্রের কোনো অনুশোচনা দেখতে পাইনি, যা অত্যন্ত দুঃখজনক।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আরেক সাবেক ভারতীয় আমলা বলেন, জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সংস্থাটির কর্মীদের সুরক্ষার ব্যবস্থা নিতে হবে।তবে গাজায় সাবেক ভারতীয় সেনা হত্যার ঘটনায় সরকারের ভূমিকা ও ইসরায়েলি বাহিনীর কঠোর সমালোচনা করেছেন সাবেক ভারতীয় রাষ্ট্রদূত এবং পশ্চিম এশিয়া বিশেষজ্ঞ তালমিজ আহমেদ। তিনি বলেন, আজ রাফাহ এলাকায় মৃত্যুর একটি ভয়ঙ্কর নৃত্য চলছে।

আহমেদ আরও বলেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন রাফাহতে লাল সীমা অতিক্রম না করতে ইসরাইলকে সতর্ক করেন। অথচ ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু তা উপেক্ষা করেছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্টের বক্তব্যের পরপরই, তারা রাফাহতে ক্রমাগত হামলা চালিয়েছে। আর ইসরায়েলি বাহিনী ইচ্ছাকৃতভাবে ও সচেতনভাবে জাতিসংঘ কর্মকর্তার গাড়িতে হামলা চালিয়েছে।

জাতিসংঘের কর্মীদের হত্যার মধ্য দিয়ে ইসরায়েল যে বার্তাটি দিল তা হলো- গাজায় যে গণহত্যা চলছে সে ঘটনায় ইসরায়েলি বাহিনী সম্পূর্ণ দায়মুক্ত।সাবেক সেনা কর্মকর্তা হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ভারত সরকারে ভূমিকায় হতাশ তালমিজ আহমেদ। তিনি বলেন, ‘আমি খুবই বিস্মিত হয়েছি। ভারতীয় সরকার বিবৃতি দেওয়ার ক্ষেত্রে খুব সংযত এবং সাবধানতা অবলম্বন করেছে। সরকার চেয়েছে বিবৃতি দিয়ে দায় এড়াতে। এখানে দায় এড়ানোর প্রশ্ন নয়, এটা খুবই স্পষ্ট যে ইসরায়েলিরা ইচ্ছাকৃতভাবে এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। তাই আমি মনে করি, আমাদের এ বিষয়ে কড়া জবাব দেওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত হয়নি।’

‘গত সাত মাস ধরে গাজায় ইসরায়েলি বাহিনী যে হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে সেটা কোনো ভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। সেখানে বেসামরিক লোকজনের ওপর চলমান হামলারই একটি অংশ জাতিসংঘের কর্মীর মৃত্যু।’ যোগ করেন তিনি।

ভারত সরকারের বিবৃতিতে যা ছিল- সোমবার সাবেক ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা হত্যার ঘটনায় গতকাল মঙ্গলবার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি বিবৃতি দেয়। সেই বিবৃতিতে বলা হয়, গাজায় জাতিসংঘের নিরাপত্তা ও নিরাপত্তা বিভাগের নিরাপত্তা সমন্বয় কর্মকর্তা কর্নেল বৈভব অনিল কালে (অব.) এর মৃত্যুতে আমরা গভীরভাবে শোকাহত। আমরা তার পরিবার এবং প্রিয়জনদের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা জানায়।

এতে আরও উল্লেখ করা হয়, নিউইয়র্কে জাতিসংঘে আমাদের স্থায়ী মিশন এবং তেল আবিব ও রামাল্লায় আমাদের মিশনে নিহত সাবেক সেনা কর্মকর্তার মরদেহ প্রত্যাবাসনে সব ধরনের সহায়তা করা হবে এবং ঘটনার তদন্তের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রাখছে সরকার।

গাজা হামলা ইস্যুতে ভারতের অবস্থান- গত বছরের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ইসরায়েলের প্রতি ‘সংহতি’ প্রকাশ করেছিলেন। যদিও ভারত বারবার বলে আসছিল তারা সব সময় যে কোনো সন্ত্রাসী হামলার বিরুদ্ধে। তবে গাজা হামলা ইস্যুতে বরাবরই ভারত ইসরায়েলের পক্ষ নিয়েছে। সাবেক সেনা নিহতের ঘটনায় আশ্চর্যজনক হলেও সত্য ভারত সরাসরি ইসরায়েলের দিকে আঙুল তুলেনি।

সাবেক ভারতীয় সেনা কর্মকর্তার হত্যাকাণ্ডে জাতিসংঘ যা বলছে- জাতিসংঘ মহাসচিবের ডেপুটি মুখপাত্র ফারহান হক বলেছেন, একটি ইসরায়েলি ট্যাঙ্ক থেকে ওই গাড়ির পেছন দিকে গুলি চলানো হয়েছিল এবং এ বিষয়ে জাতিসংঘের ‘বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই’। অথচ গাড়িতে স্পষ্ট করে ইউএন লেখা ছিল। ঠিক কোনো পরিস্থিতিতে হামলার ওই ঘটনা ঘটেছে তা জাতিসংঘ জানতে চেয়েছে এবং এ বিষয়ে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা চলছে।

ভারতীয় সেনা হত্যার ঘটনায় ইসরায়েলের অবস্থান- ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী জানায়, হত্যার ঘটনায় তারা তদন্ত করেছে। প্রাথমিক তদন্তে দেখা গেছে, হামলার শিকার জাতিসংঘের গাড়িটি একটি ‘সক্রিয় যুদ্ধ অঞ্চলে’ ছিল। তারা আরও দাবি করেছে যে, গাড়িটি যে রুট দিয়ে যাচ্ছিল সেই রুট সম্পর্কে তাদের আগে থেকে জানানো হয়নি। যদিও জাতিসংঘ জোরালো ভাবে দাবি করেছে, তারা গাড়ির গতিবিধি সম্পর্কে ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষকে আগেই জানিয়েছিল।