উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অর্ধশত এমপির বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় নির্দেশ অমান্য করার অভিযোগ

প্রকাশিত: ১১:৫৭ পূর্বাহ্ণ, এপ্রিল ১৬, ২০২৪

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ

নিজ নিজ উপজেলার রাজনীতি নিজেদের কবজায় রাখতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন আওয়ামী লীগের একশ্রেণির সংসদ সদস্যরা। অর্ধশতাধিক সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নির্দেশ অমান্য করার অভিযোগ উঠেছে। দলের হাইকমান্ড আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে কাউকে সমর্থন না দিতে এমপিদের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু এ নির্দেশনা উপেক্ষা করছেন অনেক সংসদ সদস্য। কোনো কোনো এমপির স্ত্রী, ছেলেমেয়ে, ভাই-ভাতিজা, শ্যালক, ভগ্নিপতি, মামা-ভাগ্নে, বেয়াইরা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

এদিকে, মন্ত্রী-এমপিদের কেউ প্রকাশ্যে আবার কেউ পরোক্ষভাবে স্বজন ও নিজেদের অনুসারী-অনুগত চেয়ারম্যান প্রার্থীদের সমর্থন দিচ্ছেন। উন্মুক্ত নির্বাচনে প্রভাবশালীদের এমন হস্তক্ষেপে নাখোশ আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা। দলীয় সূত্রে জানা গেছে, অর্ধশতাধিক দলীয় ও দলীয় স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ কেন্দ্রে জমা পড়েছে। তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখছে কেন্দ্র। শোকজ, সতর্কতা, তলব—এমনকি সংসদ সদস্যদের বর্তমান দলীয় পদ থেকে বহিষ্কার করার চিন্তাভাবনা চলছে।

প্রসঙ্গত, আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দলের প্রাথমিক সদস্য পদ থেকে বহিষ্কার না করলে সংসদ সদস্য পদ বহাল থাকবে। মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনরা প্রার্থী হওয়া দোষের কিছু নয়। তবে স্বজনদের সমর্থন দেওয়া সাংগঠনিক সিদ্ধান্তবিরোধী। দেশের ৪৮১টি উপজেলা পরিষদে এবার নির্বাচন হবে চার ধাপে। প্রথম ধাপের ভোট গ্রহণ হবে আগামী ৮ মে। ইতিমধ্যে প্রথম ধাপে ১৫২টি ও দ্বিতীয় ধাপে দেশের ১৬১টি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের তপসিল ঘোষণা করেছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। ২১ মে দ্বিতীয় ধাপের ভোট গ্রহণ হবে।

দীর্ঘদিন ধরে জেলা-উপজেলার আওয়ামী লীগের কমিটিতে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলো নিজেদের পরিবারের দখলে রাখার চেষ্টায় থাকতেন সরকারদলীয় এমপিরা। এবার তাদের চোখ পড়েছে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে। উপজেলায় একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন তারা। এমনকি স্বজনদের জিতিয়ে নিয়ে আসতে ‘অর্থ-ক্ষমতা-প্রভাবকে’ হাতিয়ার করে মাঠে অর্ধশত এমপি। এদের মধ্যে কয়েক জন স্বতন্ত্র এমপি রয়েছেন, যারা আওয়ামী লীগের পদধারী নেতা। এতে তৃণমূল আওয়ামী লীগে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। প্রতীক বিহীন ভোটেও কেন এমপিদের পছন্দের একক প্রার্থী করতে হবে—এ প্রশ্ন তুলেছেন সবাই।

এমপির ছেলেকে প্রার্থী না করতে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি :বগুড়ার সারিয়াকান্দি ও সোনাতলা উপজেলা নিয়ে গঠিত বগুড়া-১ আসনের সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগের সাহাদারা মান্নান। এই দুই উপজেলার মধ্যে সারিয়াকান্দিতে সাহাদারা মান্নান তার ছেলে সাখাওয়াত হোসেন সজলকে এবং সোনাতলায় ছোট ভাই মিনহাদুজ্জামানকে প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছেন। তার এই ঘোষণায় স্থানীয় নেতাদের একটি অংশ ক্ষুব্ধ। সজলকে প্রার্থী না করতে উপজেলার ১২ ইউনিয়নের মধ্যে ১১ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন। এর অনুলিপি সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল, দপ্তর সম্পাদক বিপ্লব বড়ুয়া ও বগুড়া প্রেস ক্লাবে পাঠানো হয়েছে।

প্রেসিডিয়াম সদস্যের বিরুদ্ধে নির্দেশনা অমান্য করার অভিযোগ: টাঙ্গাইল-১ (ধনবাড়ী-মধুপুর) আসনের সংসদ সদস্য, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক কৃষিমন্ত্রী মো. আবদুর রাজ্জাক তার নির্বাচনি এলাকার দুই উপজেলায় চেয়ারম্যান পদে দুই জন প্রার্থী মনোনীত করেছেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগের বিশেষ বর্ধিত সভা করে প্রার্থী ঘোষণা দেন দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামের এই নেতা। জানা গেছে, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাকের বিরুদ্ধে সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে লিখিত অভিযোগ দাখিল করেছেন ধনবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। লিখিত অভিযোগে বলা হয়েছে, সংসদ সদস্য তার নির্বাচনি এলাকায় উপজেলা নির্বাচনে আপন খালাতো ভাই ও নিজের পছন্দের ব্যক্তিকে ‘চেয়ারম্যান’ প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেছেন।

নাটোরের সিংড়া উপজেলায় লুত্ফুল হাবীবকে (রুবেল) ‘একক প্রার্থী’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। তিনি তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদের শ্যালক। মাদারীপুর সদর উপজেলায় নিজের ছেলে মো. আসিবুর রহমান খানকে প্রার্থী ঘোষণা করেছেন আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য শাজাহান খান। আসিবুর জেলা ছাত্রলীগের সহসভাপতি ও কেন্দ্রীয় যুবলীগের সদস্য। সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলায় সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রী ও বর্তমান সংসদ সদস্য এম এ মান্নানের ছেলে সাদাত মান্নান চেয়ারম্যান প্রার্থী হিসেবে গণসংযোগ করছেন। এম এ মান্নান নিজেও বিভিন্ন আয়োজনে ছেলেকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। সুনামগঞ্জ সদর উপজেলা পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক খায়রুল হুদা এবারও প্রার্থী। তার বড় ভাই জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। একই উপজেলায় সংরক্ষিত মহিলা আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শামসুন্নাহার বেগমের ছেলে যুবলীগের নেতা ফজলে রাব্বী চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করতে প্রচার চালাচ্ছেন। মানিকগঞ্জ সদর উপজেলায় প্রার্থী হচ্ছেন বর্তমান চেয়ারম্যান ও সদর উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. ইসরাফিল হোসেন। তিনি মানিকগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের ফুপাতো ভাই। কুষ্টিয়া সদর উপজেলায় সংসদ সদস্য মাহবুব-উল আলম হানিফের চাচাতো ভাই আতাউর রহমান বর্তমান চেয়ারম্যান। তিনি এবারও নির্বাচন করবেন। নোয়াখালীর হাতিয়ায় প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে স্থানীয় সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলীর ছেলে আশীক আলীর নাম। সুবর্ণচর উপজেলায় নোয়াখালী-৪ আসনের সংসদ সদস্য মোহাম্মদ একরামুল করিম চৌধুরী প্রার্থী হিসেবে তার ছেলে আতাহার ইশরাক শাবাব চৌধুরীর নাম ঘোষণা করেছেন। মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলা নির্বাচনে ভাগনে শোয়েব আহমেদকে চেয়ারম্যান প্রার্থী ঘোষণা দিয়েছেন মৌলভীবাজার-১ আসনের এমপি শাহাব উদ্দিন। চুয়াডাঙ্গা-২ আসনের এমপি আলী আজগর টগর তার নির্বাচনি এলাকা দামুড়হুদা উপজেলায় আপন ভাই আলী মুনসুর বাবুকে চেয়ারম্যান প্রার্থী করেন। নরসিংদী-৩ আসনের এমপি সিরাজুল ইসলাম মোল্লা ঘোষণা দিয়েছেন, তার নির্বাচনি এলাকা শিবপুর উপজেলায় চেয়ারম্যান প্রার্থী হবেন তার স্ত্রী ফেরদৌসী ইসলাম। তিনি তাকে সমর্থন জানাবেন।

কুমিল্লা-১০ আসনের এমপি, সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে তার ভাই গোলাম সরোয়ারকে চেয়ারম্যান প্রার্থী ঘোষণা দিয়েছেন। মুস্তফা কামালের নির্বাচনি এলাকার লালমাই উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কামরুল ইসলাম শাহীন তার ভাতিজা। নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের এমপি, সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী। দ্বিতীয় ধাপে রূপগঞ্জ উপজেলা পরিষদের ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। এ ভোটে সরকারদলীয় এই এমপি তার ছেলে গাজী গোলাম মর্তুজা পাপ্পাকে রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থী ঘোষণা করেছেন। গোলাম দস্তগীর গাজীর স্ত্রী মিসেস হাসিনা গাজী তারাব পৌরসভার মেয়র।

দলীয় প্রার্থী না দেওয়ার সিদ্ধান্তের পরও এভাবে সংসদ সদস্যদের পছন্দের ব্যক্তিদের প্রার্থী ঘোষণা করায় বিভিন্ন জায়গায় স্থানীয় কোন্দল আরও বাড়ছে। কোন্দল নিরসনে আওয়ামী লীগ পৃথকভাবে প্রতিটি বিভাগের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করছে। সেখানে নির্দেশনা দেওয়ার পাশাপাশি গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতেও অবৈধ হস্তক্ষেপ না করতে দলীয় মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের নির্দেশনা দেওয়ার কথা জানানো হয়। বিবৃতিতে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, নির্বাচনের নিরপেক্ষতা বিনষ্ট করার কর্মকাণ্ডে জড়িত না থাকার জন্য মন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগের দলীয় সংসদ সদস্য ও নেতাকর্মীদের সাংগঠনিক নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। এখানে মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ করার সুযোগ থাকবে না।