অসচেতনতা ও সাঁতার না জানায় পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু বাড়ছে

প্রকাশিত: ১১:৪০ পূর্বাহ্ণ, এপ্রিল ১৭, ২০২৪

নিজস্ব প্রতিবেদকঃ

প্রতি বছর পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর ঘটনা বাড়ছে। শিশুদের নজরদারিতে না রাখা, অসচেতনতা এবং শিশুদের সাঁতার না জানাই এই মৃত্যুর অন্যতম কারণ বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, শিশুমৃত্যুর এমন ঘটনা এ বছর ঈদ ও নববর্ষের ছুটির আগে ও পরে দুই ডজনেরও অধিক ঘটেছে বলে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা গেছে। তবে এমন অনেক ঘটনা আছে, যা প্রকাশের বাইরেই রয়ে গেছে।

নারায়ণগঞ্জের লাঙ্গলবন্দে ব্রহ্মপুত্র নদে স্নানোত্সবে পানিতে ডুবে রাজদ্বীপ নামের ৮ বছরের এক শিশুর মৃত্যু হয়েছে। ১৬ এপ্রিল মঙ্গলবার মহাষ্টমীর স্নানোত্সবের দ্বিতীয় দিনে নাঙ্গলবন্দে ব্রহ্মপুত্র নদের ৪ নম্বর ঘাটে পরিবারের সঙ্গে স্নানোতœবে এসে ডুবে মারা যায় শিশুটি। শিশুটি চট্টগ্রামের পটিয়া থানার বুদ্ধুরা বেলমাইন গ্রামের উজ্জ্বল দাসের ছেলে। ১৩ এপ্রিল শনিবার পুকুরের পানিতে ডুবে দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে। তারা মামাতো-ফুপাতো বোন। নাটোরের সিংড়ায় পুকুরের পানিতে ডুবে তাদের মৃত্যু হয়েছে। বেলা ১১টার দিকে সিংড়া উপজেলার লালোর ইউনিয়নের ঢাকঢোল ডাঙ্গাপাড়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। নিহত শিশুরা হলেন ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের ফারুক হোসেনের মেয়ে ফারিয়া আক্তার (৭) এবং নাটোর শহরের তেবাড়িয়া এলাকার সৌদিপ্রবাসী রায়হান হোসেনের মেয়ে ফাতেমা (৭)। শিশু দুটি ঈদে মা-বাবার সঙ্গে নানাবাড়িতে বেড়াতে এসে বাড়ির পাশে খেলছিল। পরে সবার অগোচরে বাড়ির পাশের পুকুরে গোসল করতে নামে। এরপর তারা ফিরে না আসায় পরিবারের লোকজন খোঁজাখুঁজি করতে থাকেন। একপর্যায়ে পরিবারের লোকজন পুকুরের পানিতে দুজনের মরদেহ ভেসে উঠতে দেখে উদ্ধার করে বাড়িতে নিয়ে আসেন। এদিকে মনিরামপুরে পানিতে ডুবে দুই ভাইবোনের মৃত্যু হয়েছে গত ৬ এপ্রিল। যশোর জেলার মনিরামপুরে পুকুরের পানিতে ডুবে সাবিদ (৪) ও সামিয়া (৫) নামের আপন দুই ভাইবোনের মৃত্যু হয়। দুপুরে উপজেলার বারপাড়া গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। সাবিদ ও সামিয়া ঐ গ্রামের মাস্টার শহিদুল ইসলামের সন্তান। গাইবান্ধার পলাশবাড়ীতে পুকুরে ডুবে সনি মিয়া (৪) নামে এক শিশুর মৃত্যু হয়। ঈদের পরদিন শুক্রবার হোসেনপুর ইউনিয়নের ঝাপর এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। সনি মিয়া ঐ এলাকার ফিরোজ মিয়ার ছেলে। পানিতে ডুবে মৃত্যুর এমন ঘটনা এ বছর ঈদ ও নববর্ষের ছুটির পরে দুই ডজনেরও অধিক ঘটেছে বলে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা যায়।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০২২ প্রতিবেদন অনুসারে, পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুমৃত্যুর ৭ শতাংশের বেশি ঘটে পানিতে ডুবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৪ সালের বৈশ্বিক প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশে পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুমৃত্যুর ৪৩ শতাংশের কারণ পানিতে ডুবে মারা যাওয়া। যুক্তরাষ্ট্রের ইনস্টিটিউট অব হেলথ মেট্রিক্স অ্যান্ড ইভালুয়েশনের (আইএইচএমই) ২০১৭ সালে প্রকাশিত গ্লোবাল বারডেন অব ডিজিজ স্টাডি শীর্ষক প্রতিবেদনে বাংলাদেশে ২০১৭ সালে ১৪ হাজার ২৯ জন মানুষ পানিতে ডুবে মারা যায়। এই রিপোর্ট অনুযায়ী পানিতে ডুবে মৃত্যুর দিক থেকে কমনওয়েলথ দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান পঞ্চম। বাংলাদেশে জাতীয়ভাবে পানিতে ডুবে মৃত্যু নিয়ে কোনো তথ্য সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় এর প্রকৃত চিত্র উঠে আসে না বলে জানান সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশ স্বাস্থ্য ও ইনজুরি সমীক্ষা ২০১৬ অনুসারে দেশে প্রতিদিন গড়ে পাঁচ বছরের কম বয়সী ৩০ জন শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। আর ১৮ বছরের কম বয়সীদের হিসাবে ধরলে প্রায় ৪০ জন শিশুর মৃত্যু হয়। পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু প্রতিরোধে ব্যাপক জনসচেতনতার বিকল্প নেই। অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য, পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর এই ঘটনা ঘটে থাকে বাড়ির নিকটতম পুকুর বা খালে, যা ঘর থেকে গড়ে প্রায় ৪০ কদম দূরে।

ন্যাশনাল অ্যালায়েন্স ফর ড্রাউনিং প্রিভেনশন (এনএডিপি) আহ্বায়ক সদরুল হাসান মজুমদার বলেন, অনাকাঙ্ক্ষিত পানিতে ডুবে মৃত্যু প্রতিরোধে শিশুদের সর্বদা নজরে রাখতে হবে। তিনি বলেন, এই অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর প্রায় ৬০ শতাংশ ঘটে থাকে সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টার মধ্যে। সে সময় পরিবারের সদস্যরা, বিশেষ করে মায়েরা প্রাত্যহিক কাজে ব্যস্ত থাকেন। অর্থাৎ, এই সময়টাতে শিশুদের, বিশেষ করে অনূর্ধ্ব পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের দেখভাল করার সার্বক্ষণিক কেউ থাকে না। উল্লেখ্য, আমাদের দেশে সামগ্রিকভাবে বিশেষ করে গ্রামীণ জনপদে শিশুদের প্রাতিষ্ঠানিক পরিচর্যার কোনো ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি।

গ্লোবাল হেলথ অ্যাডভোকেসি ইনকিউবেটরের (জিএইচএআই) সহযোগিতায় গণমাধ্যম ও যোগাযোগবিষয়ক প্রতিষ্ঠান সমষ্টি গণমাধ্যমে প্রকাশিত ঘটনা থেকে পানিতে ডুবে মৃত্যুর তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছে। সমষ্টির প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত গণমাধ্যমে পানিতে ডুবে ৮৮০টি মৃত্যুর ঘটনা প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে ৮৭ শতাংশ ঘটনায় ভুক্তভোগীর বয়স ছিল ৯ বছরের নিচে। এই হার ২০২২ সালের তুলনায় ৬ শতাংশ বেশি। মোট মৃত্যুর এক-তৃতীয়াংশের বেশি ঘটেছে সকাল থেকে দুপুরের মধ্যে—অর্থাৎ, সকাল থেকে দুপুরের মধ্যে ৩৯৪ জন এবং দুপুর থেকে সন্ধ্যার আগে ৩৮৮ জন মারা যায়। এছাড়া সন্ধ্যায় ১৫৪ জন মারা যায়। ২০ জন রাতের বেলায় পানিতে ডোবে। ১২ জনের মৃত্যুর সময় প্রকাশিত সংবাদ থেকে নিশ্চিত হয় যায়নি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০১৭ সালে প্রকাশিত প্রিভেন্টিং ড্রাওনিং: অ্যান ইমপ্লিমেন্টেশন গাইডে স্থানীয় পর্যায়ের মানুষকে সম্পৃক্ত করে দিবাযত্ন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেছে। এছাড়া পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যু রোধে পারিবারিক পর্যায়ে সচেতনতা তৈরি এবং জাতীয়ভাবে কর্মসূচি গ্রহণের ওপরও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও স্থানীয় প্রতিষ্ঠান সুপারিশ করেছে।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়: ‘সমাজভিত্তিক সমন্বিত শিশুযতœ কেন্দ্রের মাধ্যমে শিশুর প্রারম্ভিক বিকাশ ও সুরক্ষা এবং সাঁতারসুবিধা প্রদান’ শীর্ষক একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়। দুই বছর মেয়াদি প্রকল্পটি ২০২২ সালে শুরু হওয়ার কথা থাকলেও এখনো শুরু হয়নি।